নিজস্ব প্রতিবেদক, সাইবারবার্তা.কম: সচেতন রই, #সাইবার_স্মার্ট_হই’ প্রতিপাদ্যে শুরু হলো অক্টোবর মাসব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা কর্মসূচি। শুক্রবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছে ‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস বিষয়ক জাতীয় কমিটি ২০২১’।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এ বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। তিনি তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনফরমেশন সিস্টেমস অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের (আইসাকা) ঢাকা চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট। মাসব্যাপী কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরেন ক্যাম জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।
আরও বক্তব্য দেন ক্যাম জাতীয় কমিটির সদস্য, সিসিএ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট কাজী মুস্তাফিজ, কর্মসূচির পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান রবির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রাইভেসি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সনজয় চক্রবর্ত্তী, ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক প্রমুখ।
২০২১ সালের এই ক্যাম্পেইন বাস্তবায়নে পার্টনার হিসেবে থাকছে প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টার, সিসিএ ফাউন্ডেশন ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। এছাড়া এবারের কর্মসূচিতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকছে – মোবাইল ফোন অপারেটর রবি ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সাইবার প্যারাডাইজ লিমিটেড।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি ও জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, দেশে ক্রমেই নানা ধরনের প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এটির ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে নেতিবাচক দিকগুলোও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই হারটা কেবল ভাবিয়েই তুলছে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে জন্ম দিয়েছে নতুন শঙ্কা।
বাংলাদেশে ২০১৬ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে অক্টোবরের জনসচেতনতামূলক এই কর্মসূচি পালন শুরু হয়। আইসাকাও আন্তর্জাতিকভাবে এই কর্মসূচি পালন করে আসছে। প্রতি অক্টোবরে ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে মাসব্যাপী নানা সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও।
ইকবাল হোসেন বলেন, অক্টোবরের চার সপ্তাহে আলাদা প্রতিপাদ্য বা থিম নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী ক্যাম্পেইন বা প্রচারাভিযান হয়। ২০২১ সাল থেকে দেশব্যাপী এই কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দিতে আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টার ও সিসিএ ফাউন্ডেশন এবং সংশ্লিষ্ট করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও প্রযুক্তি পেশাজীবীদের নিয়ে প্রথমবারের মতো গঠিত হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী প্ল্যাটফর্ম ‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস বিষয়ক জাতীয় কমিটি (বাংলাদেশ)’ – National Committee on Cybersecurity Awareness Month (Bangladesh).
ক্যাম জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বিনোদন সব কিছুতেই মহাসড়ক হয়েছে ইন্টারনেট। কিন্তু এই মহাসড়কে দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। সড়কের সিগন্যাল সম্পর্কে না জানা বা বোঝার পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের মাধ্যমেও দিন দিন এখানে আক্রান্তের সংখ্যাটা বাড়ছে। অনেকেই জেনে এবং না জেনে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে সংগঠনটির উপদেষ্টা রাশনা ইমাম বলেন, ২০১৯-২০২০ সালে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন একাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। জরিপ থেকে এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের মতো একটি নতুন অপরাধ শনাক্ত করা হয়।
জরিপে সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ। যেখানে ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম ছিল। যদিও ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, কিন্তু এবার এই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশে। সাইবার অপরাধের বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮-৩০ বছর এবং ভুক্তভোগীদের হার ৮৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। বোঝা যাচ্ছে, দেশে ‘সাইবার সচেতনতা’ বাড়ানোর পাশাপাশি ‘সাইবার লিটারেসি’ও বাড়াতে হবে।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট কাজী মুস্তাফিজ বলেন, সমাজে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার কাজ সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একাকি করা সম্ভব নয়, সবার সম্মিলত দায়িত্ব এটি। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধাকরদের এই কাজে সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
রবির ভাইস প্রেসিডেন্ট সনজয় চক্রবর্ত্তী বলেন, গত ১২ বছরের রবির যতো গ্রাহক তৈরি হয়েছে তাদের ৭৫ শতাংশ ইন্টারনেট নিয়মিত ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি অঘটনও বাড়ছে। সাইবার জগতে শতভাগ সুরক্ষিত বলতে কিছু নেই। তাই ভার্চুয়াল জগতে নিরাপদ থাকতে হলে নিজেকেই সচেতন হতে হবে।
ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইন্টারনেট সেবাদাতাদের বলেছেন প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সুবিধা প্রত্যেক গ্রাহককে যেন বাধ্যতামূলকভাবে দেয়া হয়। কিন্তু কয়জন অভিভাবক আমাদের কাছে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল সুবিধা চেয়ে নেন? ইন্টারনেট ব্যবহারে সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ’
অক্টোবরের ক্যাম কর্মসূচি:
যেকোনো ব্যক্তি/ সংগঠন/সংস্থা/প্রতিষ্ঠান/ক্লাব ‘ক্যাম চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে অনলাইনে (cyberawarebd.com) সাইনআপের মাধ্যমে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের অংশ হবেন। তারা জাতীয় কমিটির প্রণীত বাংলা টুলকিট ব্যবহার করে নিজেদের আয়োজনে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবেন। এসবের মাধ্যমে ক্যাম জাতীয় কমিটি আশা করছে- খুব অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাম ক্যাম্পেইন বিশ্বের বাংলাভাষীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করবে। পৌঁছে যাবে দেশের সব ভোক্তা, ছোট ও মাঝারি আকৃতির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তরুণ সমাজসহ তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিটি মানুষের কাছে।
আমেরিকার ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স (এনসিএসএ) এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ) পৃথিবীজুড়ে সাইবার সচেতনতা মাসের নেতৃত্ব দিচ্ছে। গত বছর সারা পৃথিবীর ৫০টির বেশি দেশের অগণিত বাণিজ্যিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের অসংখ্য সাইবার চ্যাম্পিয়ন সাইবার সচেতনতা মাসের কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা পোস্ট করা, বিভিন্ন ধরনের রিসোর্স তৈরি, প্রবন্ধ রচনা ও প্রকাশ, অনলাইন ইভেন্ট পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ‘সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা মাস চ্যাম্পিয়ন’বৃন্দ পৃথিবীর মানুষকে সাইবার জগতে নিরাপদ হতে সহযোগিতা করেছে।
এবারের ক্যাম কর্মসূচির থিম বা প্রতিপাদ্য:
২০২০ সালের একই প্রতিপাদ্য (Do Your Part, #BeCyberSmart) আন্তর্জাতিকভাবে এবারও (২০২১) ‘সাইবার সচেতনতা মাসের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে পরিগণিত হবে। এবার বাংলাভাষীদের জন্য ‘সচেতন রই #সাইবার_স্মার্ট_হই’ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে জাতীয় কমিটি। এর ভাবার্থ হলো- সাইবার নিরাপত্তা শুধুই যৌথ দ্বায়িত্ব নয়, এটি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দ্বায়িত্বও বটে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি শুধুমাত্র কোনো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব নয়, বরং প্রথমত আমাদের সবার ব্যক্তিগত দায়িত্ব। আমরা সবাই যদি আমাদের যার যার অবস্থান থেকে অনলাইনে শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করি, ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের জানাতে পারি বা নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্যে এ বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করি- তাহলে আমাদের ভার্চুয়াল জগৎ আরও বেশি নিরাপদ হবে এবং সবার তথ্য সুরক্ষিত থাকবে।
এছাড়া পুরো মাসের কর্মসূচিকে চারটি সপ্তাহে ভাগ করে বিষয়ভিত্তিক সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে থাকছে- প্রথম সপ্তাহ (৪-৮ অক্টোবর): সাইবার স্মার্ট হই, দ্বিতীয় সপ্তাহ (১১-১৫ অক্টোবর): ফিশিং প্রতিরোধ, তৃতীয় সপ্তাহ (১৮-২২ অক্টোবর): সাইবার সিকিউরিটিতে ক্যারিয়ার এবং চতুর্থ সপ্তাহ (২৫-২৯ অক্টোবর): সবার আগে সাইবার নিরাপত্তা। এই চার সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ওয়েবিনার, কর্মশালা, ক্যাম্পেইন আয়োজন থাকবে ঢাকাসহ সারাদেশে।
লোগো এবং ব্র্যান্ডিং: আমেরিকার ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি অ্যালায়েন্স (এনসিএসএ) এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ) ২০২০ সালে সাইবার সচেতনতা মাসের লোগো প্রণয়ন করে। তার আদলে বাংলাদেশের ‘সাইবার সচেতনতা মাস বিষয়ক জাতীয় কমিটির (এনসিক্যাম)’ তৈরি সার্বজনীন লোগোটি যে কোনো সময়ে যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ব্যবহার করতে পারে।
অনলাইন জগতের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং ব্যক্তিগত সাইবার নিরাপত্তার উপর আলোকপাত করে প্রণীত সাইবার সচেতনতা মাসের লোগো, ব্র্যান্ডিং নির্দেশনা এবং মূল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ নিয়ে একটি টুলকিট বা পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এবং বাইরে সাইবার সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় সব উপকরণ এই টুলকিটে পাওয়া যাবে। ক্যাম চ্যম্পিয়ন হয়ে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান/সংগঠন এই বাংলা টুলকিট ব্যবহার করে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মসূচি সহজেই আয়োজন করতে পারবেন। cyberawarebd.com ওয়েবসাইট থেকে বাংলা টুলকিট বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যাবে।
(ঢাকাটাইমস/১অক্টোবর/কেএম/)