শনিবার, মে ১৮ ২০২৪ | ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল | ৯ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

এক ছাদে বেড়ে উঠলেই পারিবারিক মানুষ হয় না

রাশেদা রওনক খান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজ আমাদের গ্রামের সৈয়দাবাদ সরকারী কলেজের ছাত্র ছিল! এই কলেজটি প্রতিষ্ঠাতা আমার চাচা মরহুম এবিএম সিদ্দিকি,যার একটাই আশা ছিল, একদিন এই গ্রাম ও আশে পাশের এলাকার ছেলে-মেয়েরা এই কলেজ হতে শিক্ষা লাভ করে দেশের সকল বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হবে… নিজেদের কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বলে, একইসাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র বলে হাফিজের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাকে যার পর নাই ভাবাচ্ছে নানা কারণে| একটা বড় কারণ, শিক্ষক হিসেবে ওর মতো শিক্ষার্থীদের আমরা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাই| হাফিজ ২০১৪ সালে এই কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিল | পরিবারে সচ্ছলতা ছিলোনা ঠিকই, ছিল ছেলেটির মেধার উপর পরিবারের অপার বিশেষ, আস্থা ও ভরসা| অনেক কষ্ট করে এতো দূর যাওয়া….

 

 

আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন, এই এতো কষ্ট করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম হতে যাওয়া দরিদ্র পরিবারের একমাত্র বাতিঘর হয়ে উঠা সন্তানগুলোকে কারা কিভাবে কেন এভাবে শেষ করে দিচ্ছে? আসলে কেউ কি কাউকে শেষ করে দিতে পারে এভাবে, যদি নিজে থেকে শেষ হতে না চায়? নাকি পারে? এই যে খবরে প্রকাশ পেলো, আইবিএ পড়া ছেলেরা এসবের ব্যবসা করছে, নিজেরাও নেশা করছে, কেন? সমাজের চোখে, পরিবারের চোখে তো ওরা মেধাবী! তবে কোথায় সূত্র মেলে না অংকের?

কিভাবে প্রথম বর্ষ বা দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রটি ধীরে ধীরে মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে, দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা হতে তা খুব কাছ থেকে চোখে দেখা আমার | সেইসব গল্পগুলো নিশ্চয়ই কখনো না কখনো করবো| রুমে বসে কতজনকে যে কাউন্সিলিং করেছি, কতো কারণে, এই যেমন, প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে পড়া-লেখা ছেড়ে দেয়া, বাবা মায়ের বিসিএস পরীক্ষা দেবার চাপ, হয় পরিবারের নয় সমাজের চাপ, পিয়ার গ্রুপের প্রেশার, হলের বড় ভাইদের রাজনীতি, রুমের আড্ডার কারণে পড়তে সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, প্রেমিকার পরিবার হতে হুমকি ধামকি, পড়া-লেখা ভালো না লাগা, ইত্যাদি আরও বহু কারণ|

 

 

ঢাকার এলিট ক্লাসের ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্বে কারো কারো জায়গা না হওয়া গ্রাম কিংবা মফস্বল হতে আসার কারণে, বন্ধুর জন্মদিনে গিফট কেনা নিয়ে সংকোচ- অনেকেই এসব আমার সাথে শেয়ার করতো, আমিও চেষ্টা করতাম আমার সাধ্যের মাঝে তাদের এসব সংকোচ হতে বের করে ফেলার| আমার ক্লাসের প্রথম দিন আমি ঢাকা বনাম মফস্বল কিংবা গ্রামের বন্ধুত্ব নিয়ে একটা কিছু বলবোই, তা এতদিনে আমার শিক্ষার্থীরা জানে| বন্ধুত্ব হবে কেবল আত্মার সাথে আত্মার, সেখানে কে কোথা হতে এলো, গেলো, জন্মাল, এসব তুচ্ছ বিষয়কে কারা কিভাবে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় তা এখন আর অপরিষ্কার নয়| তবুও যারা বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, তাদের মাথা থেকে এই চিন্তা বের করে দেবার একটা চেষ্টা চালাই, কিছু হয়তো কাজ হয়, কিছু হয়তো হয়না!

 

 

যাই হউক, মাদক ছাড়া অন্য ইস্যুগুলোতে কারো কারো দুশ্চিন্তা দূর করতে সাফল্য কম ছিলোনা, কিন্তু মাদকের বেলায় যেন হেরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছিলো। মাদকের সাথে হয়তো অন্যান্য অনুষঙ্গ যুক্ত থাকে, আবার অনেক ক্ষেত্রে থাকেও না। এই সমস্যা ছেলেমেয়ে উভয় ক্ষেত্রেই আছে, কিছু ক্ষেত্রে ছেলেদের বেশী, কিছু ক্ষেত্রে মেয়েদের| আমার ফেসবুকে বহু শিক্ষার্থী আছে, যারা তাদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে এখনো ইনবক্সে আলাপ করে| ইনবক্সে আর কারো উত্তর দেই কিংবা না দেই, শিক্ষার্থীদের কোন সংকট নিয়ে মেসেজ দিলে তার উত্তর দেয়া আমি ফরজ কাজ মনে করি, তা সে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীই হউক না কেন! কেবল তাদের ইদ মোবারক বা জন্মদিন টাইপ শুভেচ্ছার উত্তর দেয়া সম্ভব হয়না, কিন্তু কেউ কখনো কোন সমস্যা নিয়ে আমাকে নক করবে, আমি তা শুনবো না, এই উদাহরণ খুব কম| ফলে তাদের সাথে আমার যোগাযোগটা বেশ সহজ ও সরল|

 

 

সর্বশেষ যে ছাত্রটিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক চেষ্টা করেছিলাম তার ইয়াবার নেশা থেকে বের করতে, বিভাগে নানা ধরণের জটিলতা তৈরি করে সেও আজ অন্ধজগতে বুঁদ হয়ে আছে হয়তো বা! অথচ বাবা মা জানেনই না যে তাদের ছেলে এই জগতে চলে গেছে! ছেলেটি প্রথম দুই তিন বছর যখন ক্লাসে আলোচনা করতো, তার চিন্তা জগতের গভীরতা অন্যদের চেয়ে একটু ভিন্ন মনে হতো, একটি বিষয়কে নানাভাবে দেখার ও বুঝার চিন্তা জাগতিক মনন ছিল তার, যা আমাকে অভিভূত করতো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে ক্লাসরুমে সবচেয়ে আনন্দদায়ক হচ্ছে, যখন শিক্ষক বুঝতে পারে যে, তার শিক্ষার্থীরা পাঠের সাথে চিন্তাজগতের যুগসূত্র স্থাপন করতে পারছে। সে ছিল তেমনই একজন, রেজাল্টও ভালো করছিলো, হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন!

 

 

ক্লাসে আসে, কিন্তু ঝিম মেরে বসে থাকে| প্রশ্ন করলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে যেন সে অন্যজগতের বাসিন্দা, এই মাত্রই ফিরল অন্যভুবন ঘুরে! বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে| ওর বন্ধুদের ডাকলাম, তথ্য জোগাড় করে জানতে পারলাম, ও খুব ভালভাবেই নেশায় ঝুঁকে পড়েছে| আমার মাথায় হাত! বলে কি!! তোমরা কিছুই করতে পারো নি? ওদের উত্তর, না ম্যাম, ও এখন নেশায় চলে গেছে, কেউ কিছু করতে পারবে বলে মনে হয়না। আমি ওকে পরের দিন ক্লাস হতে বের হবার পর করিডোরে ডাক দিলাম, ওর বন্ধুরা সব থমকে গেলো, ভাবলো, আমি বোধহয় ওকে সবার সামনেই কিছু বলবো। না, আমি কেবল ওকে ডেকে বললাম, তুমি পাঁচ মিনিট পর আমার রুমে আসো। ও বুঝতে পেরেছে কিনা, আমাকে এড়ানোর জন্য বললো, ম্যাম দুপুরের পর আসি? আমি বললাম, না এখনই আসো। ও এলো রুমে। আমি টের পাচ্ছি, ওর বন্ধুরা আমার রুমের পাশে ঘুরে ঘুরে করছে টেনশনে। আমি দরজা খুলে বের হতেই সব হু হু করে দৌড়!

জানতে চাইলাম, কি হয়েছে তোমার, বলো?
ও চুপ করে থাকে|
কিছু একটা তো হয়েছেই! সেটা কি? ছ্যাঁকা খেয়েছো?
ছেলেটি মাথা নিচু করে আছে, হাতের আঙ্গুলগুলো কিছুটা কাঁপছে।
আমি বললাম, কেন নেশা ধরেছো? আমাকে জানাও।

 

 

এবার সে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো, এই বুঝি দৌড় দেবে রুম থেকে…ও কল্পনাও করেনি আমি এভাবেই ওকে বলে বসতে পারি!
আমি শান্ত চোখে বললাম, বসো। পালতে হবেনা…… আমি তোমার কাছ থেকে যা জানতে চাইছি তার উত্তর দাও।
ও দাঁড়িয়ে থাকে, বসে না। আমি আবার বলি, বসো। বুঝলাম, ওকে সহজ করতে হবে…আগেই এনিয়ে রাখা সিঙ্গারার প্লেট হতে নিজে একটা নিয়ে বাকি দুটো ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এটা খাও, চা দিচ্ছে, চা খাও। তোমার শরীর কাঁপছে, ক্ষুধায় হয়তো না, কিন্তু তবুও খাও| তারপর আমাকে বুঝিয়ে বল, কেন এভাবে নিজের জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছ? আমার জানতে হবে, কেন কি হয়েছিল যে এই বিপদ ডেকে আনলে। ও কথা বলে না, অস্বীকার করছে আমার কথা, তাও না।
বুঝলাম, ও ভয় পাচ্ছে একজন শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে যে ও মাদক নেয়।

 

 

আমি ওকে অভয় দিয়ে বললাম, আমি তোমার মুখ হতে উত্তর না শুনে তোমাকে এই রুম হতে যেতে দিচ্ছিনা| তুমি যদি বলো যে, আমাকে বলবে না, বা আমার তোমাকে জোর করে জানার কোনো অধিকার নেই, তবুও আমি বলবো, আমার আছে, আমি তোমার শিক্ষক, আমার সেই অধিকার আছে। আমি এটাও জানি, তুমি যদি কাউকে বিষয়টি খুলে বলতে চাও বা পারো, সেটা আমি|

 

এবার সে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, আমি জানিনা আমি কিভাবে জড়িয়ে গেছি। তারা আমার হলের বড় ভাই, বন্ধুর মতো। একসময় মিশতে মিশতে তাদের মতো করে আমিও মাদক নেয়া শুরু করি। তারপর তার পুরাতন প্রেম, নতুন প্রেম, সম্পর্কের ঝামেলা, রাজনৈতিক ঝামেলা, পদ-পদবী, হলে সিট পাওয়া, নেতা হয়ে উঠা, ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হতে থাকে… আমি শুনছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম, সেদিনের ফার্স্ট ইয়ারে আসা ছেলেটি একলা একলা কতো কিছু নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে…পরিবার কি তা জানে! সে নিজেও কি জানে এতোটুকুন বয়সে যেখানে কেবল তার পরিসর হওয়ার কথা ছিল ক্যাম্পাস আর পড়ালেখার জগত, সেখানে এতোসব কোথা থেকে তার উপর ভর করে বসেছে? কেন? এগুলো কি একান্তই তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নাকি কেউ চাপিয়ে দিচ্ছে তাকে? এই সমাজ কিংবা পরিবার কিংবা ক্যাম্পাস? কে বা কারা? নাকি সে নিজেই?

 

আরেকটি ঘটনা বলি। একবার এক মাদকাসক্ত ছাত্রের প্রেমিকার অনুরোধে সেই ছাত্রের মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে আলাপ করতেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন, কি বলেন ম্যাডাম? আমি তো ভাবতেই পারছিনা, আমার তো শেষ সব! তাঁর গলা কাঁপছিল, নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন জোরে জোরে| আমি কিছুটা আতংকিত হয়ে গেলাম, বললাম, আচ্ছা আমি দেখছি, আপনি শান্ত হউন| উনি যত না ছেলের এই দশা নিয়ে চিন্তিত, তার চেয়ে বেশী ছেলের বাবা উনাকে মেরে ফেলবে, সেই ভয়ে অস্থির হচ্ছিলেন! আমি অবাক হইনি, এ আমাদের ঘরে ঘরে বাবাদের ধারণা, ছেলে-মেয়ে বিপথে যাওয়ার পেছনে একমাত্র মা’ই দায়ী, যেন অন্য যে হাজারো কারণ থাকতে পারে, তা তারা এড়িয়ে যায়| এমনকি সন্তানরা যে ভিন্ন কোন মনোজগতে বাস করতে পারে, সেই ভাবনাও তাদের মাঝে কাজ করেনা| প্প্রেমিকার কাছ থেকে জানতে পারি ছেলেটি ছোট বেলা হতেই ডিপ্রেশনে ভুগছে, অথচ পরিবারের কেউ তা টেরই পায়নি! যাই হউক, আমি বেশ হতাশ হলাম উনার পরবর্তী কাজ কারবার দেখে| বুঝলাম, আমাদের সহজ সরল মাগুলো এমন বোকাই হয়| বাবার ভয়ে সন্তান এর খারাপ অভ্যাসের কথা লুকিয়ে গিলে ফেলেন আমাদের অনেক মা। ছেলে সন্তানদের নিয়ে তাদের পাহাড় সমান আশা ভরসার জায়গায় এমন কিছু তারা কল্পনাতেও আনতে পারেন না| আর যখন কল্পনা থেকে বাস্তবে নেমে আসেন, ততদিনে সন্তান তলিয়ে যায় গভীর সমুদ্রে, আর টেনে তুলতে পারেন না!

 

শেষ একটা ঘটনা বলি| একবার এক ডাক্তার মা আমাকে ফোন দিলেন, তাঁর মেয়েকে নিয়ে তিনি চিন্তিত| তাদের টাকার কোন অভাব নেই, এতো বিত্ত বৈভব, দেশের বাইরে নিয়ম করে বছরে এক/দুইবার ঘুরতে যায়, প্রেম করতে কোন বাধা নিষেধ নেই, বাসায় বন্ধু বান্ধব আসে যায়, গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে, বাসায় কয়েকজন হেলপার আছে, মেয়ের কি অভাব রেখেছেন তিনি, যে মেয়েকে নেশা করতে হবে! মা অনেকটাই বাধ্য হয়ে আমাকে ফোন দিয়েছেন| সরাসরি দিতে লজ্জা বা সংকোচ হচ্ছিলো, দিয়েছেন আমার এক পরিচিত মানুষের মাধ্যমে যিনি তার কলিগ| আমাকে কান্না জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন| আমার সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, তবুও চুপ করে মায়ের কান্না শুনছি, এই শোনাটাও জরুরী ঐ মুহূর্তে, তাতে যদি মায়ের দীর্ঘশ্বাস কিছুটা হাল্কা হয়! কিন্তু তাই কি আর হয়! আমার ফোন নাম্বার মেয়ের একটি ডায়েরিতে পেয়েছেন, সেখানে নাকি আমার সাথে করিডরে কিংবা রুমে তার সাথে বিভিন্ন সময়ের কথা বলা, ইত্যাদি অনেক বর্ণনা আছে।

 

 

আমাকে ফোন করার একটাই কারণ, মেয়ে যখন এসব নেশায় ছিলোনা, যখন প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়, তখন মেয়েটি বাসায় গিয়ে আমার গল্প করতো। সেই মেয়েটি কি করে এমন হয়ে গেলো, এবার পাল্টা প্রশ্ন মাকেই করলাম| তখন শেয়ার করতো, এখন কেন আর করেনা, তা কি কখনো জানতে চেয়েছেন ওর কাছে? কিভাবে দূরে সরে গেলো আপনার কাছ থেকে, কখন? উনি ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আমি কান্না শুনে চলছি…এক পর্যায়ে আমারও নিশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছিলো, আমি চুপ হয়ে থাকি, ওপাশের এক অসহায় মায়ের সামনে আমি এক অসহায় শিক্ষক…. কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আমরা চাইলেই খুব ব্যক্তিগতভাবে শাসন করতে পারি না| অসহায় লাগে যখন দেখি, ওদের সাথে আমাদের একটা অদৃশ্য দেয়াল আছে, সেই দেয়াল যেখানে বাবা-মাই ভাঙতে পারেনা, আমরা কি করে পারবো? তবুও এই মায়ের আবেদন ফেলতে পারিনি, কি হয়েছিলো আমাদের মাঝে কয়েক মাস, তা না হয় নাই বললাম, তবে মেয়েটি এখনও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে….কিন্তু সেই অদৃশ্য দেয়ালের কারণে জানতে চাইতে পারিনা, তুমি আমাকে যে কথা দিয়েছিলে, তা কি এখনো মেনে চলছো? কোথায় যেন সংকোচ হয় পাছে ও আমায় মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়।

 

তবে এইটুকু বুঝি, কিছু মানুষের মনোরোগ আছে, চিন্তায় জটিলতা আছে, শূন্যতা আছে, হাহাকার আছে, এগুলো বিত্ত বৈভব কিংবা দারিদ্রতা কোনো কিছুর সাথেই যুক্ত নয়। এগুলো পাওয়া কিংবা না পাওয়ার সাথেও অনেকটা বিযুক্ত। এই ধরণের সমস্যায় একমাত্র উপায় কাউন্সিলিং করানো। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এর কাছে যাওয়া। এগুলো হতে রক্ষার আসলে খুব একক সহজ পথ নেই। আমরা সহজেই বলে ফেলি, কি অভাব ছিল তার, কেন সে এরকম একটা কাজ করলো? ওতো খুব ভালো রেজাল্ট করছিলো, ওকে নিয়ে আমাদের এতো সব স্বপ্ন, ও অমুক হবে, তমুক হবে, কেন হঠাৎ এইরকম হয়ে গেলো? কিন্তু একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিমানুষের যে কিসে অভাব সে নিজেই অনেক সময় জানেনা, আপনি-আমি জানবো কিভাবে? পরিবারের সদস্য হিসেবে অন্যের দোষ খুঁজি, হয়তোবা নিজের দায়িত্বকে এড়ানোর জন্য|

 

সচ্ছল কিংবা অসচ্ছল পরিবারের এই সন্তানগুলোকে কারা কিভাবে মাদকের হাতছানিতে ভুলিয়ে নিয়ে যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি! হাফিজের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, বন্ধু সঙ্গকে যদি দোষ দেই, তাহলে মেয়েটির ক্ষেত্রে তো এই বাস্তবতা ছিলোনা| প্রতিবছর যে লাখো ছাত্র বের হচ্ছে, সবাই তো এই অন্ধকার জগতে ডুবে যাচ্ছেনা! খেলার মাঠ নেই, ফ্লাট কালচারে একাকী বড় হওয়া, আগের মতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা নেই, এইগুলো তো হাফিজের সাথে মিলে না। ও সংস্কৃতিবান একজন মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি অঙ্গন তার পদছারনায় মুখরিত ছিল, মূকাভিনয় করতো, খেলা-ধুলা করতো, গ্রামের সবুজ ঘাসের গন্ধে যার বেড়ে উঠা, তার কেন এলসিডির মতো মাদকের ঘ্রান নেবার সাধ জাগে? এই প্রশ্নের কি উত্তর হতে পারে?

 

বিষয়গুলো কি আমরা পরিবারের মানুষজন কি একটু ভেবে দেখবো? একজন ১৮ বছরের অধিক বয়সী মানুষের আত্মহত্যা করার পেছনে অন্য অনেক কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু যে সম্পর্ক সবচেয়ে আগে আমাদের বিবেচনা করা দরকার, তা হলো, পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক! পারিবারিক বন্ধন! পরিবারে একসাথে এক ছাদে বেড়ে উঠলেই যে একজন মানুষ পারিবারিক মানুষ তা কিন্তু নয়, হয়তো আমাদের অগোচরেই সে তার এক নিজস্ব জগৎ গড়ে তুলেছে, যেখানে সে শূন্যতা কে খুঁজে, আশকারা দেয়, শূন্যতাকে উপভোগ করে! সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে, সেখানে অন্য যেকোনো কিছু তুচ্ছ মনে হয়, প্রেম, ভালোবাসা, বাবা মায়ের স্নেহ, ভাইবোনের ভালোবাসা, পরীক্ষা, রেজাল্ট, বাবামায়ের স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব- এই সকল কিছুকেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ মনে হয়! কিন্তু আমরা পরিবারের লোকজন ভাবি, সে কখন বিসিএস অফিসার হবে, শিক্ষক হবে, চাকুরী পাবে, বিয়ে করবে, সন্তান হবে, সমাজের বেধে দেয়া আপনার-আমার এই সামাজিক-পারিবারিক অংকের সাথে ও হয়তো কোনোদিন সূত্র মেলাতেই চায়নি, চেয়েছে অন্য কিছু যা আপনি আমি আমরা পরিবারের মানুষজন কোনোদিন অনুধাবনই করিনি, কিংবা করতে চাইও নি!

 

লেখক: রাশেদা রওনক খান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
লেখাটি তার ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত

শেয়ার করুন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
আরও পড়ুন

নতুন প্রকাশ