কাজী আনিছ: প্রথম আলো সমীপে,প্রিয় রোজিনা ইসলাম আপা জামিন পাওয়ার সংবাদটি শুধু সংবাদকর্মী নয়, আপামর জনসাধারণের জন্য একটি প্রাথমিক আনন্দের সংবাদ। সকালে সংবাদটি পেয়ে স্বস্তিতে মনটা ভরে গেল।অভিনন্দন সবাইকে। আশা করি, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটিও প্রত্যাহার হবে অচিরেই। আমার সবচেয়ে আনন্দ,উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ শেষে মা-মেয়ের দেখা হবে। আলভিনা তার মাকে কাছে পাবে। ভাবতেই আনন্দাশ্রুতে ভরে যায় চোখ।
রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গই গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখানে সব শ্রেণি, পেশা, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবারই কথার গুরুত্ব দিতে হয়, রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে। শুধু প্রথম আলো বা প্রথম আলো’র সংবাদকর্মী বলেই নয়, মানুষ রোজিনা ইসলামের জন্য প্রতিবাদ আন্দোলন করেছে সাংবাদিকতার স্বার্থে, স্বাধীনভাবে তথ্যসংগ্রহের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের জন্যে। মানুষের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হোক, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে হোক বা যেভাবেই হোক, এ ঘটনা সমাধানের পথে এগোবে বলে আমার বিশ্বাস। সাংবাদিক সংগঠনগুলোও বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে। তাঁরাও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
এই প্রতিবাদ থেকে অনেকের অনেক কিছু শেখার আছে। বিশেষ করে আছে প্রথম আলো’র জন্য। যে সংগঠনগুলো একে একে প্রথম আলোর সংবাদকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছে, প্রথম আলো তাঁর কোনো কর্মীকে কখনও সাংবাদিকদের সংগঠনে সক্রিয় হওয়ার অনুমতি দেয় না। অথচ সাংবাদিক সংগঠনেরও যে গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি, তা এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো। প্রথম আলোর সংবাদকর্মীর আশপাশে দাঁড়িয়েছে আপামর মানুষ। কিন্তু প্রথম আলোর কিছু কর্মীর গায়ে, গতরে, আবরণে, আচরণে, পোশাকে এমন এলিট ভাব যে তাদের ধারেকাছে সাধারণ মানুষ বাদ দেন, অন্য কোনো গণমাধ্যমের কর্মীরা ঘেঁষতে পারেন না।
রিপোর্টারদের মধ্যে এ এলিটভাব খুব কম। এ ভাব বেশি ডেস্কে বসা কয়েকজনের মাঝে। ডেস্কের বড় আসনে বসা লোকগুলোর মাঝে এ ‘হামবড়া’ ভাব সবচেয়ে বেশি। ডেস্ক বলতে সংবাদ, প্রশাসন, অ্যাকাউন্টস, ফিচার-প্রভৃতি সেকশনে কিছু মানুষের আচরণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। প্রথম আলোকে এ আচরণ পরিবর্তন করে মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চর্চা শুরু করতে হবে এখন থেকেই।
প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের মধ্যে ‘তোয়াক্কা’ না করার ভাবও বেশ প্রবল। কিছুদিন আগে সংবাদকর্মী ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আমরা অনেকেই কথা বলেছি। বিবৃতি দিয়েছি।
যেখানে দেশের প্রথিতযশা ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ও সাংবাদিকবৃন্দ বিবৃতির মাধ্যমে ছাঁটাই না করার অনুরোধ করেছিলেন। প্রথম আলোর সম্পাদক তা শুনেননি। তোয়াক্কা করেননি। এমনকি এ নিয়ে আলোচনা-বৈঠকের যে আহ্বান জানানো হয়েছিল, তা সম্পাদক করেননি। প্রথম আলোতে থাকা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী-কেউ এ ব্যাপারে মুখ পর্যন্ত খুলেননি। শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক যিনি সবসময় বাকস্বাধীনতার কথা বলেন, তিনিও শিক্ষক-সাংবাদিকের কথাকে গুরুত্ব দেননি। এমনকি সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে অনেক সুপরিচিত শিক্ষকেরাও পর্যন্ত এ ছাঁটাই নিয়ে মুখ খুলেননি।
এ যে কারো মতামতকে তোয়াক্কা না করার যে সংস্কৃতি চলে, তা থেকে খোদ প্রথম আলো ও ওই ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক মুক্ত নন। প্রথম আলোর কর্মীদের সঙ্গেও এ তোয়াক্কা না করার মনোভাব দেখানো হয়। ভয়ে সবাই তটস্থ থাকেন। এমনকি ছাঁটাইবিরোধী আন্দোলনের পর তাঁর ভয়ে প্রথম আলো’র অনেক সহকর্মী আমার ফোন পর্যন্ত ধরেননি। শীর্ষস্থানীয় দুয়েকজনের একরোখা আচরণ থেকে প্রথম আলোকে মুক্ত করতে হবে।
আশা করি, প্রথম আলোর সম্পাদক, প্রথম আলোতে কর্মরত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারবেন, মানুষের কথার গুরুত্ব কেমন, মানুষের কথার শক্তি কেমন, কেন মানুষের কথাকে গুরুত্ব দিতে হয়, যত “নিম্নশ্রেণির” লোক কথা বলুক না কেন।
শুরুতে সমাধান করতে না পারেন, অন্তত কথা বলতে হয়, আলোচনা করতে হয়, পরিশেষে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়।
এ প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আশা করি প্রথম আলো সম্পাদক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী তাদের অস্বস্তিকর এলিট খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন মিশে যাবেন জনমানুষের কাতারে।
লেখক: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার ফেসবুক পোস্ট থেকে লেখাটি সংগৃহীত।
(সাইবারবার্তা.কম/আইআই/২৩ মে ২০২১)