সাইবারবার্তা ডেস্ক: দেশে নিষিদ্ধ ‘স্ট্রিমকার’ নামের লাইভ ভিডিও ও চ্যাট অ্যাপ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের বিশেষায়িত অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)।গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে একজন তরুণীও রয়েছেন।অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তা এটিইউর সহকারী পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এটা নিয়ে কাজ করছিলাম আমরা। এর একটি অংশ ধরা পড়েছে। পরবর্তী তদন্তে বাকিদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
বুধবার বারিধারায় পুলিশের এই বিভাগের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই নিষিদ্ধ অ্যাপ বাংলাদেশে কিভাবে পরিচালনা করা হয়, কারা জড়িত এবং ব্যবহারকারীদের প্রলুব্ধ করাসহ টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও পাচারের তথ্য তুলে ধরা হয়।সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন এটিইউর পুলিশ সুপার মাহিদুজ্জামান। আরও উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার আসলাম হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, স্ট্রিমকার অ্যাপটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। ভিপিএন ব্যবহার করে এ দেশ থেকে যুক্ত হন ব্যবহারকারীরা।
এসপি মাহিদুজ্জামান জানান, অভিযানে তারা এই অ্যাপ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত একটি এজেন্সির ‘স্যালারি শিট’পেয়েছেন।প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে তাদের ধারণা সম্প্রতি দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অ্যাপটির সঙ্গে অন্তত এক হাজার তরুণী যুক্ত।কর্মকর্তারা জানান, ‘নারীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ও জুয়া খেলার’ এই অ্যাপের সেবা নিতে বিশেষ ভার্চুয়াল বা ডিজিটাল মুদ্রা কিনতে হয়, যা হাতবদল হয়ে মূলত দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মঙ্গলবার সাভার, নোয়াখালীর সুধারাম ও রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।তারা হলেন – জমির উদ্দিন (৩৫), কামরুল হোসেন ওরফে রুবেল (৩৯), মনজুরুল ইসলাম হৃদয় (২৬) ও অনামিকা সরকার (২৪)।তাদের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মুদ্রা পাচার আইনে একটি মামলা করা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ ভিডিও ও লাইভ চ্যাটের প্ল্যাটফর্ম স্ট্রিমকার অ্যাপটির বিজ্ঞাপনে আকর্ষণীয় তরুণীদের সঙ্গে আড্ডা (লাইভ চ্যাট) দেওয়ার কথা প্রচার করা হয়।চটকদার এসব বিজ্ঞাপন দেখে যারা অ্যাপের লাইভ চ্যাটরুমগুলোতে যোগ দিতে চান তাদের নগদ অর্থ খরচ করে অ্যাপের নিজস্ব মুদ্রা (কয়েন) বা ডিজিটাল বা ভাচুর্য়াল কারেন্সি কিনতে হয়।অ্যাপটিতে রয়েছে ছয় ধরনের জুয়া খেলার সুযোগও। অনেকে আড্ডা দিতে ঢুকে জুয়া খেলায় অভ্যস্ত হয়ে দেদারসে টাকা খোয়ান বলে এটিইউর কর্মকর্তারা বলেন।কর্মকর্তারা বলেন, এই চক্রের মূল লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা। যারা ভালো আয় করলেও পরিবার থেকে দূরে থাকার কারণে অনেকটা নিরানন্দ জীবনযাপন করেন।
নিষিদ্ধ ‘স্ট্রিমকার’ অ্যাপ বাংলাদেশে কিভাবে পরিচালনা করা হয়, কারা জড়িত, টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও পাচারের তথ্য বুধবার বারিধারায় পুলিশের বিশেষায়িত অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। পুলিশের ভাষ্য, এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিমাসে বাংলাদেশিদের অন্তত শতকোটি টাকা পাচার হচ্ছে।পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাপটিতে দুই ধরনের আইডি আছে। একটি হোস্ট, অন্যটি সাধারণ ব্যবহারকারীর আইডি। এগুলোর অনুমোদন দেওয়ার জন্য অনেকগুলো ‘এজেন্সি’গড়ে তোলা হয়েছে দেশজুড়ে।হোস্ট আইডিগুলো হয় সাধারণত তরুণী, কিশোরী বা নন্দিত তারকাদের। একটি এজেন্সির অধীনে অন্তত ১৫টি হোস্ট আইডি থাকতে হয়।তবে দেশের একেকটি এজেন্সির অধীনে দেড় থেকে দুইশ পর্যন্ত হোস্ট আইডি রয়েছে।
অভিযানের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ব্যবসা অনেক বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি এজেন্সি হোস্ট সামলাতে একাধিক সাব এজেন্সিও খোলার অনুমতি দিয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে জমিরউদ্দীন ‘ব্ল্যাক রোজ’ এজেন্সি ও হৃদয় ‘এভারগ্রিন’ এজেন্সির মালিক।হৃদয়ের মামা কামরুল হোসেন রুবেল ওই এজেন্সির লেনদেন দেখভাল করেন। এ কারণে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।আর গ্রেপ্তার হওয়া অনামিকা নিজেও হোস্ট করেন।এছাড়া তার স্বামী রোকনউদ্দীন সিদ্দিকী ‘লগআউট এজেন্সি’র মালিক।সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জমজমাট হয়ে ওঠা লাইভ চ্যাটের এই ‘ব্যবসার’ অন্যতম ‘মাসুদ আর খান এজেন্সি’র মালিক মাসুদ রানাকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। তিনি এখন পালিয়ে পাশের কোনো দেশে অবস্থান নিয়েছেন বলে পুলিশের কাছে খবর রয়েছে।
যেভাবে চলে অ্যাপটি
চাইলেই কেউ সরাসরি অ্যাপে যুক্ত হতে পারেন না। প্রথমে যে কোনো একটি এজেন্সির কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়।এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে ‘বিনস’ নামে পরিচিত অ্যাপের মুদ্রা কিনতে হয়। এক লাখ বিনস কিনতে খরচ হয় ১০৮৮ টাকা।ওই টাকায় চ্যাটরুমে ঢুকে পছন্দমত তরুণী বা তারকাকে বিনস ‘উপহার’ পাঠাতে হয়।এরপর তাদের চ্যাটরমে যুক্ত করা হয়, যেখানে নানান আলাপের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আড্ডা হয়।পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, ওই বিনস ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ব্যবহারকারী আড্ডার বদলে ওই অ্যাপে থাকা জুয়া খেলতে বসে যান।
অ্যাপটিতে তিন পাত্তি, ট্রেজার হান্ট, লাকি পয়সা, ক্রিকেট স্টারস ইত্যাদি নামে ছয়টি জুয়া আছে।প্রতি তিন মিনিটে একটি করে জুয়ার বোর্ড ‘ওঠে’ বা সমাপ্ত হয়। কর্মকর্তাদের হিসাবে প্রতিতিন মিনিটে জুয়া থেকে প্রায় এক লাখ টাকা উঠিয়ে নেয় অ্যাপটি।
যত লোক যুক্ত
এটিইউ কর্মকর্তারা অভিযানকালে একটি এজেন্সির বেতন বিবরণী (স্যালারি শিট) উদ্ধার করেন। তারা জানান, ওই বেতন বিবরণীতে শ’খানেক তরুণীর আইডি নাম, বিকাশ নম্বর ও দেনা পাওনার বিবরণী রয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে এসপি মাহিদুজ্জামান বলেন, একটি এজেন্সির ‘স্যালারি শিট’ থেকে ধারণা করা যায় অ্যাপটির সঙ্গে অন্তত এক হাজার তরুণী যুক্ত। তারা হোস্ট হিসেবে লাইভে উপস্থিত হয়ে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে ‘আড্ডা’ দেন। দেশেই আছে বেশ কিছু এজেন্সি।
‘স্যালারি শিটের’ সূত্র ধরে কথা বলেনএক নারী।তিনি বলেন, “ফেসবুকে ঘরে বসে আয়ের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি সেখানে আইডি খোলেন। মাস শেষে ২২ থেকে ৩৮ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন হয়েছে।“তবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বলে তিনি ওই অ্যাপে আর নিয়মিত আসছেন না।দেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান ও সাবেক কিছু তারকাও অ্যাপের আড্ডায় যুক্ত হন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
লেনদেন ও পাচার
এসপি মাহিদুজ্জামানের দাবি, ওই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিমাসে শতকোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়।তিনি বলেন, “হুন্ডি, হাওয়ালা ও একটি ব্যাংকের মাধ্যমে নগদ অর্থ বিদেশে পাচার করেন এজেন্সি মালিকেরা।“পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ওই অ্যাপের এজেন্সিগুলো পাশের দেশ থেকে নগদ অর্থ দিয়ে অ্যাপের মুদ্রা বা বিনস কিনে আনেন।বিনস হলো অ্যাপের ভার্চুয়াল মুদ্রা, যেটি দিয়ে আড্ডা বা জুয়া খেলার সুযোগ পাওয়া যায়।বিনস দেশে কেনাবেচার ব্যবস্থা না থাকায় অর্থ পাচারের মাধ্যমে তা করা হয়। অর্থ পাচার ব্যবস্থাপনায় এ দেশের কয়েকটি এজেন্সি দুবাইতে অফিসও খুলে বসেছে বলে কর্মকর্তারা জানান।ওই অফিসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশি গ্রাহকদের অর্থ তারা সেদেশ থেকে নগদায়ন (ক্যাশ) করেন। যেগুলো আর কখনোই দেশে আসে না।চ্যাটের পাশাপাশি জুয়ায় প্রচুর বিনস ওড়ান প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলে অভিযানকালে জানতে পেরেছেন কর্মকর্তারা।স্ট্রিমকারের উদ্যোক্তা একজন মার্কিন নাগরিক। তবে ভারত ও পাকিস্তান থেকে অ্যাপটি মূলত পরিচালনা করা হয়। এটির দর্শক বা ব্যবহারকারী মূলত বাংলা, হিন্দী ও উর্দুভাসীরা।
বাংলাদেশিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার কারণ
এটিইউ কর্মর্তারা বলছেন, ইন্টারনেটে ঢুকলে বিগোসহ বিভিন্ন ধরনের লাইভ চ্যাটের বিজ্ঞাপন আসতে থাকে।তবে স্ট্রিমকারের বিশেষত্ব হলো এটিতে হাজারের ওপর বাংলাদেশি তরুণী, কিশোরী ও তারকারা যুক্ত রয়েছেন।বিগোতে ভিয়েতনামী তরুণীদের সংখ্যা বেশি। ভাষাগত তারতম্যের কারণে বাংলাদেশিরা ওই অ্যাপগুলো পছন্দ করেননি। এ কারণে বাংলাভাষীদের বাজার দখল করে রখেছে স্ট্রিমকার।
হোস্টদের বেতন
দুজন হোস্ট এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অ্যাপের নিয়মানুযায়ী একজন হোস্টকে মাসে ৪০ ঘণ্টা লাইভে থাকতে হয়। বেতন পেতে হলে একজন হোস্টের অ্যাকাউন্টে মাসে ন্যূনতম ২০ লাখ বিন্স (বা জেমস) জমাতে হয়।২০ লাখ বিনস জমালে ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা বেতন পান একজন হোস্ট।হোস্ট হওয়ার জন্য ফেইসবুকে পেইজ খুলেও পোস্ট দেওয়া হয়েছে।এটিইউ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ‘স্যালারি শিটে’ দেখেছেন অনেক হোস্টের বেতন লাখের কাছাকাছিও পরিশোধ করা হয়েছে। তবে তাদের যে বেতন দেওয়া হয় তা গ্রাহকদের কাছ থেকে তাদের উপার্জিত অর্থের সিকি অংশও নয়।এসপি মাহিদুজ্জামান বলেন, “চেষ্টা চলছে দেশের ভেতর এজেন্সিগুলোর চক্র ভেঙে দেওয়ার জন্য।“এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনার কথা জানান তিনি।সৌজন্যে:বিডিনিউজ২৪
(সাইবারবার্তা.কম/আইআই/২০ মে ২০২১)