রিফাত আহমেদ, সাইবারবার্তা: কখনো ভেবে দেখেছেন আপনার স্মার্টফোন আপনার সম্পর্কে কী কী জানে? আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কাকে ম্যাসেজ করছেন, কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন, কিসের ছবি তুলছেন, অনলাইনে কোন খাবার অর্ডার করছেন, কোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, আপনার পছন্দের মুভির ধরণ, এমনকি আপনার ব্যাংকিং তথ্য – এ সব কিছুই সংরক্ষিত থাকে আপনার ফোনে।
ভয়ংকর হলেও সত্য যে এই সব তথ্য আপনার ফোন আপনার কাছে থাকা সত্ত্বেও চলে যেতে পারে অন্য একজনের হাতে স্টকারওয়্যারের বা স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে। দেশের বা বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে আপনার ফোনের এসব তথ্য দেখতে, সংরক্ষণ করতে ও ক্ষেত্রবিশেষ পরিবর্তন করতে পারবে নিমিষেই, এই ম্যালওয়ারের মাধ্যমে।
স্টকারওয়্যার কি?
স্টকারওয়্যার (Stalkerware) হলো সেকল মেলিসিয়াস সফ্টওয়্যার বা ম্যালওয়ার যা অনুমতি ছাড়াই কোনো ডিভাইসে অনুপ্রবেশ করানো হয় ডিভাইসটির মালিকের উপর করা নজরদারি রাখতে বা তার গোপনীয় তথ্য চুরি করতে।
স্টকারওয়্যারের সাহায্যে কিভাবে নজরদারি করা হয়?
যে ব্যক্তিকে নজরদারি করা হবে তার ফোনে স্টকারওয়্যার ইন্সটল করার মাধ্যমে সব তথ্য হাতিয়ে নেয়া হয় এবং ফোনের হতে থাকা সকল কার্যকালাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু এই স্টকারওয়্যার ইন্সটল করতে প্রয়োজন হয় ভিক্টিমের ফোনের। সেই ফোনের এক বার ইন্সটল করা হয়ে গেলে সেই স্টকারওয়্যারের মাধ্যমে নজরদারি রাখা যায় দেশে-বিদেশে যেকোনো প্রান্ত থেকে।
ভিক্টিমের ফোনের মাধ্যমে কাকে কল করা হচ্ছে, কোন নাম্বার থেকে কল আসছে, কাকে ম্যাসেজ পাঠানো হচ্ছে, কি ম্যাসেজ আসছে, ভিক্টিম কোথায় কোথায় যাচ্ছে এমনকি সেই ফোনের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন ব্যবহার করে অডিও ভিডিও কল ও ব্যবহারকারীর ও আসে পাশের ছবি তোলা যায় স্টকারওয়্যারের মাধ্যমে। এগুলো করা হয় ভিক্টিমের ফোনের লোকেশন, ক্যামেরা, কল লগ, মাইক্রোফোন ও অন্যান্য সেন্সিটিভ তথ্য গ্রহণের অনুমতি স্টকারওয়্যারকে দেয়ার মাধ্যমে। এভাবেই ভিক্টিমের বিনা অনুমতিতে নজরদারি করা হয় তার প্রত্যেকটি পদক্ষেপের।
স্টকারওয়্যার মূলত কারা নজরদারির জন্য ব্যবহার করে?
যেহেতু এই সফটওয়্যার ইন্সটল করতে ভিক্টিমের ফোন কাছে থাকার প্রয়োজন হয় তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন কেউ নজরদারির জন্য স্টকারওয়্যার ইন্সটল করে যে ভিক্টিমের ফোন সহজেই ব্যবহার করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকট আত্মীয় ও স্বজন যেমন ভিক্টিমের স্বামী বা স্ত্রী, বন্ধু, সহকর্মী, বাবা-মা এমনকি সিনিয়র কর্মকর্তা বা অফিসের বস স্টকারওয়্যার ব্যবহার করে ভিক্টিমের উপর অবৈধ নজরদারি করার জন্য।
ফোনে স্টকারওয়্যারের অনুপ্রবেশ কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?
১) ফোনকে কোথায় একা ফেলে রাখবেন না। এতে করে আপনার পরিচিত বা অপরিচিত কেউই আপনার ফোনের স্টকারওয়্যার ইন্সটল করার সুযোগ পাবে না।
২) ফোনে সবসময় লক ব্যবহার করুন যেন ফোন কারো হাতে এলেও বায়োমেট্রিক, প্যাটার্ন বা পিন লক থাকার কারনে ফোন আনলক করে স্টকারওয়্যার ইন্সটল করতে না পারে।
৩) ফোনের লক ও সেটিংসয়ে কঠিন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। জন্ম তারিখ, নাম, ফোন নাম্বার – এসব পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
৪) এন্ড্রয়েডের জন্য গুগলের অফিসিয়াল প্লে স্টোর ও আইফোনের জন্য অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর ব্যতীত অন্য কোনো প্লাটফর্ম থেকে অ্যাপ ইন্সটল করবেন না।
৫) ইন্সটল করা অ্যাপ লিস্ট কিছুদিন পর পর চেক করুন। কোনো অচেনা অ্যাপ ফোনে দেখতে পেলে সেটি সাথে সাথে আনইন্সটল করে ফেলুন।
৬) এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন যেগুলো নিয়মিত স্ক্যান করে আপনার ফোনে স্টকারওয়্যার বা ম্যালওয়্যারের অস্তিত্ব আছে কিনা জানান দিবে।
ফোনে স্টকারওয়্যার আছ কিনা কিভাবে বুঝবেন?
ফোনে লোকেশন, ক্যামেরা, কল লগ, মাইক্রোফোন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া আছে কোন কোন অ্যাপকে সেই তথ্যগুলো পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে খুব সহজেই ফোনের স্টকারওয়্যার আছে কিনা তা বোঝা যায়।
আইফোন বা আইপ্যাড ব্যবহারকারীদের এজন্য যেতে হবে ফোনের সেটিংসে। সেখান থেকে প্রাইভেসি অপশনে গেলে দেখা যাবে কোন কোন অ্যাপ ফোনের লোকেশন, কল লগ, মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ বা প্রেরণ করছে।
অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের এই তথ্য গুলো দেখার জন্য সেটিংসের প্রাইভেসি অপশনের গিয়ে পারমিশন ম্যানেজার পেজে প্রবেশ করতে হবে। সেখানে আইওএস ডিভাইসগুলোর মতো দেখা যাবে কোন অ্যাপ ফোনের কোন কোন ডাটা সংরক্ষণ করছে।
ফোনের স্টকারওয়্যার অস্তিত্ব আছে কিনা তা বোঝার আরেকটি উপায় হলো ফোনের ব্যাটারির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ। হঠাত করে ফোনের ব্যাটারি খুব দ্রুত শেষ হতে থাকলে ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো লুকোনো স্টকারওয়্যার সর্বক্ষণ ডাটা সংরক্ষণ ও প্রেরণ করছে বলে ধরে নিতে পারেন।
ফোনে স্টকারওয়্যার পাওয়া গেলে কি করবেন?
১) ফোনের স্টকারওয়্যার পাওয়া গেলে সাথে সাথে ফোনের সেটিংস অপশন থেকে ফ্যাক্টরি রিসেট করে নিন। এতে করে স্টকারওয়্যারসহ ফোনে ম্যানুয়ালি ইন্সটল করা সকল অ্যাপ ফোন থেকে মুছে যাবে।
২) রিসেট করার পর ইমেইল, ব্যাংকিং ও অন্যান্য একাউন্টের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন কারন স্টকারওয়্যারের মাধ্যমে ফোনে থাকা পাসওয়ার্ডগুলো খুব সহজেই কোনো অসাধু ব্যাক্তির কাছে চলে যেতে পারে। চুরি হতে পারে ব্যাংক একাউন্টে থাকা অর্থ বা ব্যক্তিগত ম্যাসেজ, ছবি ও তথ্য।
৩) নিকটস্থ থানায় যোগাযোগের মাধ্যমে সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে এ বিষয়ে জানান।
৪) জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভবিষ্যতে অন্য কাউকে নিজের ফোন দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
(সাইবারবার্তা.কম/এমএ/৭মে২০২১)