সাইবারবার্তা ডেস্ক: অভিবাসী হয়ে কষ্টের জীবন পেরিয়ে বাংলাদেশের মাহবুব আলম এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় পরিচিত মুখ।
মাহবুব আলমকে এই পরিচিতি এনে দিয়েছে চলচ্চিত্রে অভিনয়। ‘বান্ধবী’, ‘সিটি অব ক্রেন’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হয়েছেন। ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পুরস্কারও পেয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জের সরকারি তোলারাম কলেজে পড়াশোনা করা মাহবুব এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় চলচ্চিত্র তৈরি এবং পরিবেশনবিষয়ক এম অ্যান্ড এম ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির সিইও। বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়ার পরিচালক।
মাহবুব আলমের অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ’, ‘হোয়ার ইজ রনি’, ‘বান্ধবী’, ‘দ্য সিটি অক ক্রেন’, ‘পেইনড’, ‘ইউ আর মাই ভ্যাম্পায়ার’, ‘প্রিফেক্ট প্রপোজাল’, ‘আসুরা: সিটি অক ম্যাডনেস’, ‘লাভ ইন কোরিয়া’।
এখন সাফল্য ধরা দিলেও মাহবুবের শুরুর গল্পটা এমন ছিল না। মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে ২১ থেকে ২২ বছর বয়সী মাহবুব দক্ষিণ কোরিয়ায় যান ১৯৯৯ সালে। একটি পোশাক কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ ও নোংরা পরিবেশে কাজ শুরু করেন। তবে সাত মাসের মাথায় মাহবুব আলমের মা মারা যান। দক্ষিণ কোরিয়ায় মাহবুবের বড় ভাই আগে থেকেই ছিলেন, সেই ভাইও দেশে চলে আসেন। মাহবুব ভাগ্য ফেরাতে থেকে যান দেশটিতে।
সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলার সময় মাহবুব তার অভিবাসী জীবনের কথায় ফিরে যাচ্ছিলেন বারবার। বলেন, অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবরই বেশি প্রকাশ বা প্রচার হয়।
কর্মীদের বৈষম্য-বঞ্চনার পরিবেশ পরিবর্তনের আশায় আস্তে আস্তে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে অংশগ্রহণ, সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকেন মাহবুব। তখন এটাও বুঝতে পারেন, পথেঘাটে শুধু আন্দোলন করলেই হবে না, গণমাধ্যমেও জায়গা করে নিতে হবে।
অভিবাসী কর্মীদের নিজস্ব গণমাধ্যমের প্রয়োজনের চিন্তা থেকে মাহবুব আলম তথ্যচিত্র তৈরি করতে থাকেন। কোরিয়ার জাতীয় গণমাধ্যমে সেগুলো প্রচার ও প্রকাশ করা হয়। এর বিনিময়ে সম্মানীও পাওয়া যেত।
২০০৪ সালে মাহবুবসহ অন্য ১০ থেকে ১২টি দেশের অভিবাসী কর্মীদের উদ্যোগে ‘মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার টেলিভিশন’ যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ কোরিয়ায়। ২০০৬ সাল থেকে তাঁরা চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে। এ আয়োজনের পরিচালক ছিলেন মাহবুব।
ছোট পর্দায় কোরিয়ান ভাষায় বিভিন্ন সংবাদ পাঠসহ বিভিন্ন চ্যানেলে উপস্থিত হয়ে মাহবুব আস্তে আস্তে পরিচিতি পেতে শুরু করেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য রোড অব দ্য রিভেঞ্জ’–এ অভিনয় করেন প্রথম। চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সও করেন। এ সময় বড় পর্দায় কাজ করার ইচ্ছাটাও তাঁর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্র নিয়ে মাহবুব বলেন, দেশে থাকা অবস্থায় অভিনয় সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁর। ‘বান্ধবী’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে বড় পর্দায় অভিনয়ের যাত্রা শুরু।
২০০৮ সালের দিকে মাহবুবের ডাক পড়ে এই চলচ্চিত্রের জন্য। তবে অভিনয়ের জন্য নয়। চিত্রনাট্যের সঙ্গে অভিবাসীদের বাস্তব অভিজ্ঞতার মিল আছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব পান তিনি। পরিচালকের ইচ্ছা ছিল, অভিবাসীদের মধ্য থেকেই একজনকে নায়ক করার। যিনি কোরিয়ার ভাষা ভালো জানেন, ভিসাগত কোনো সমস্যাও নেই।
মাহবুবও এ ধরনের নায়কের খোঁজ করতে থাকেন। তবে যাকেই আনা হয় পরিচালকের পছন্দ হচ্ছিল না। একসময় মাহবুব নিজেই অভিনয় করার ইচ্ছার কথা জানান। মাহবুব বলেন, তখন শুরু হয় আসল পরীক্ষা। ১২ থেকে ১৩ কেজি ওজন কমাতে হয় তাকে স্বল্প সময়ে।
মাহবুব জানান, চলচ্চিত্রটির বাংলা ‘বান্ধবী’ নাম দেওয়ার পেছনেও তার ভূমিকা আছে। তিন কোটি টাকায় নির্মিত চলচ্চিত্রটি একটি ভালোবাসার গল্প। একই সঙ্গে অভিবাসী কর্মীদের নানান সমস্যাও তুলে ধরা হয়। এতে বাংলায় ছোট একটি গানও আছে। ছয় মাস পর একটি চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বান্ধবী’র প্রিমিয়ারে মাহবুব প্রথম নিজের অভিনয় দেখার সুযোগ পান।
মাহবুব আলম বলেন, বড় বড় পোস্টারে নিজের ছবি দেখতে ভালোই লাগে। কোরিয়ার দর্শকদের অনেকেই তাঁর সঙ্গে এসে ছবি তোলেন। তিনি কোরিয়ান ভাষায় যে সংলাপ বলেছেন, তা ডাবিং কি না, তাও জানতে চান অনেকে।
মাহবুব বলেন, বান্ধবী চলচ্চিত্রটি বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়েছে। বাংলাদেশি দর্শকসহ বিভিন্ন দেশের দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছে। তবে অনেক দর্শক জাতিগত বিদ্বেষ থেকে অপছন্দ বা ঘৃণাও করেছেন। টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকিও পেতে হয়েছে তাঁকে।
তবে দমে না গিয়ে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার প্রেরণায় আরও চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মাহবুব। তিনি বলেন, ১০ কোটি টাকার বাজেটেও কাজ করেছেন তিনি। ইচ্ছা আছে আরও বড় বাজেটের চলচ্চিত্রে কাজ করার।
এই পর্যায়ে মাহবুব হাসতে হাসতে বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় নায়ক হিসেবে পরিচিতি পেলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ হয়নি। তবে কয়েকজন পরিচালক তাঁকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।
জীবনের ৪০ বছর পেরিয়ে আসা মাহবুব বলেন, ‘সব মিলে আমি বেশ ভালো আছি। কোনো কাজ পছন্দ না হলে সে কাজ আমি করি না। আর চ্যালেঞ্জ থাকলে সে কাজে বেশি উৎসাহ পাই।’
‘আমি আমার কাজের মধ্য দিয়ে অন্য একটি দেশে বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও পরিচিত করাতে পেরেছি—বিষয়টি ভাবতে ভালো লাগে,’ বলেন মাহবুব আলম।
মাহবুব বিয়েও করেছেন প্রবাসে, ভালোবেসে কোরিয়ান মেয়ে লি মিয়ংকে। মাহবুব আলম জানালেন, অভিনয় বা কোরিয়ার মেয়ে বিয়ে করার বিষয়ে পরিবার খুব খুশি না, আবার বিরক্তও না। সব মিলে পরিবারের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ আছে। দেশে এসে তাঁর স্ত্রীও বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করেন।
নয় ভাই ও দুই বোনের বিশাল পরিবারে মাহবুবের জন্ম। বাবা আছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেন মাহবুব। সৌজন্যে: প্রথম আলো
(সাইবারবার্তা.কম/এমআর/৩০মার্চ২০২১)