বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ৬ ২০২৫ | ২৩শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - শীতকাল | ৬ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে আরও আলোচনার আহ্বান

:: নিজস্ব প্রতিবেদক, সাইবারবার্তা.কম :: 

বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ বাতিল করে ইতোমধ্যেই সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এতে যাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাদের হাতে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বা তাদের কাজের জবাবদিহির বিষয়টি এই অধ্যাদেশে নেই। এটি নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গত ২৪ ডিসেম্বর সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন দেয়। সরকার বলছে, এ অধ্যাদেশ দ্বারা সাইবার স্পেস এবং একই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে।

 

অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে তদন্ত, বিভিন্ন অবকাঠামোতে প্রবেশসংক্রান্ত বিধানসহ কনটেন্ট ব্লকের বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সাইবার সুরক্ষার কথা বলা হলেও আইনে প্রতিকার পেতে গিয়ে কেউ ভুক্তভোগী হলে ব্যক্তির সুরক্ষার বিষয়টিও উল্লেখ নেই।

 

অর্থাৎ ব্যক্তি, তৃতীয় পক্ষের অপরাধের শাস্তির বিশদ বর্ণনা থাকলেও সরকারের জবাবদিহি উপেক্ষিত। অন্যদিকে কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের বিধানগুলোতে সুস্পষ্ট বিধান না থাকায় আইনের অপপ্রয়োগের সুযোগ বাড়াবে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সরকারের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানালেও অনুমোদিত খসড়ায় থাকা বিভিন্ন ধারা নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক বলেন, সাইবার অপরাধ দমনের পাশাপাশি নাগরিক সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর জন্য আরও বেশি আলোচনা হওয়া দরকার এবং খসড়াটি নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।

 

সরকারে থাকা ব্যক্তিদের দায়: 

চলতি বছর ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) থেকে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ও অনলাইনে বিক্রির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল। এসব তথ্য চুরি হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি সংস্থার কর্মীদের আইডি ব্যবহার করে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী ওয়্যারড এক খবরে জানিয়েছিল, এনটিএমসি তাদের ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত একটি অরক্ষিত তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য উন্মুক্ত করে রেখেছিল। হ্যাকাররা সেসব তথ্য চুরি করেছে। একই বছর জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা মানুষের লাখ লাখ ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটেছিল। এ ঘটনাগুলো ছাড়াও তদন্তনাধীন অবস্থায় কম্পিউটার, মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনাও ঘটেছে।

 

সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের ধারা ১৭-তে বলা আছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশের দণ্ড এবং ১৮-তে বলা আছে, কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশের দণ্ড। অর্থাৎ আইনগত প্রক্রিয়ায় যিনি প্রবেশ করছেন, তিনি যদি এ অপরাধে যুক্ত হন, সে ক্ষেত্রে কী হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা খসড়ায় নেই।

 

যদিও ধারা ৩৯-এ তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তি, সত্তা বা সেবা প্রদানকারীর তদন্তসংশ্লিষ্ট তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষার বিধান রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খসড়ায় ব্যক্তির সংজ্ঞা অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী বা তদন্তকারী ব্যক্তি পড়বেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।

 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, পুরো আইনে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো অনিয়ম করেন, সে ক্ষেত্রে এ আইন অনুযায়ী তাদের দায় কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বলা যায়, যাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাদের জবাবদিহির বিষয়টিও নিশ্চিত করা উচিত।

 

অধ্যাপক মইনুল বলেন, এখানে বলা যেতে পারে যে ব্যক্তিগত উপাত্ত সুরক্ষার আইনে সংশ্লিষ্ট বিধান থাকবে। কিন্তু খসড়া পর্যায়ে থাকা সে আইনেরও কোনো অগ্রগতি নেই। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও উপাত্ত সুরক্ষা আইনের প্রসঙ্গ উল্লেখ নেই। এটা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণসংক্রান্ত অপরাধের দণ্ডের একটি ধারা ছিল, যা এবারের খসড়ায় আলাদা করে রাখা হয়নি। এটা রাখা প্রয়োজন ছিল।

 

কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ:

সাইবার নিরাপত্তা আইনের আটটি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে কিছু বিতর্কিত ধারা ছিল। উল্লিখিত বিতর্কিত ধারাগুলোর অনেক অপপ্রয়োগ ছিল সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু অনুমোদিত খসড়ায় সাইবার বুলিংয়ের মধ্যে মানহানি, অপমান যুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাইবার বুলিংয়ের মধ্যে মানহানি, অপমান, মিথ্যা তথ্যের মতো বিষয় যুক্ত করে স্পিচ অফেন্সকে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এতে আইনটির অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে।

 

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, আইনে যদি কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ–সংক্রান্ত বিধান করতে হয়, তখন বিশদ আলোচনা জরুরি। কারণ, একটি দেশে নানা মত ও সম্প্রদায়ের মানুষ থাকে। এদের একেকজনের জন্য কনটেন্টের অভিঘাত একেক রকম হতে পারে। কনটেন্ট নিয়ে আইন করতে গেলে সমালোচনা থাকবে। কিন্তু এই সমালোচনা এবং ক্ষতির বিষয় যত কমিয়ে আনা যায়, আইন তত জনবান্ধব হয়ে ওঠে।

 

ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে, এমন কোনো তথ্য প্রকাশের দণ্ডের বিধান রয়েছে এ খসড়ায়। এ প্রসঙ্গে মিরাজ আহমেদ বলেন, ‘অনুভূতিতে আঘাত’–জাতীয় অস্পষ্ট শব্দ এ ধারার অপপ্রয়োগের পাশাপাশি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে ঝুঁকি তৈরি করবে। এর ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

 

তথ্য–উপাত্ত অপসারণ বা ব্লকের ক্ষেত্রে বিটিআরসির ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এখানে বিচার বিভাগীয় তদারকি থাকতে হবে। জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক পর্যালোচনা সাপেক্ষে অস্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি যে পক্ষের কনটেন্ট ব্লক বা অপসারিত হচ্ছে, তাদের আপিলের সুযোগ দিতে হবে।

(সাইবারবার্তা/০১জানুয়ারি/২০২৫/১৪২৪/কম)

শেয়ার করুন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
আরও পড়ুন

নতুন প্রকাশ