শুক্রবার, এপ্রিল ২৬ ২০২৪ | ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - গ্রীষ্মকাল | ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

অনুপ্রেরণা: মাটি কাটার আয়ে ল্যাপটপ কেনা, এখন মাসে আসে ২ লাখ টাকা

কখনো মাটি কাটা, কখনো ধান কাটার কাজ। এসবের আয় থেকে যে টাকা জমিয়েছেন তা দিয়ে ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনেছেন। তাও পুরনো ল্যাপটপ। এখন তিনি মাসে আয় করেন প্রায় দুই লাখ টাকা। অনুপ্রেরণামূলক এই বাস্তব গল্প বাংলাদেশের নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার। বিস্তারিত প্রতিবেদনে –

নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পশ্চিম মাধনগর গ্রামে থাকেন নিয়ামুল। বাবা মোহাম্মদ হোসেন আলী প্রামাণিক কৃষক। অসচ্ছল পরিবার। তাই ২০২০ সালের শেষ দিকে এইচএসসি পাস করে ল্যাপটপের জন্য টাকা জোগাড় করার উদ্যোগ নিলেন। এইচএসসি পাস নিয়ামুল দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে থাকলেন। কখনো খেতে মাটি কাটার কাজ, জমিতে ধান লাগানো, আবার কখনো মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন নিয়ামুল আর টাকা জমাতে থাকেন। এভাবেই চলল প্রায় চার মাস। এরপর ঢাকায় এসে ৪২ হাজার টাকায় একটি পুরোনো (সেকেন্ড হ্যান্ড) ল্যাপটপ কেনেন নিয়ামুল।

বাড়ি ফিরে এবার শেখার পালা। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার জন্য চাই প্রশিক্ষণ। আবারও সেই টাকার চিন্তা। নিয়ামুল আবার শুরু করলেন দিনমজুরি। টাকা জমানোর পর অনলাইনে স্কিলআপার নামে এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল বিপণনের কোর্স করেন। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনলাইনে কাজ শুরু করেন ২০২১ সালে। এরপর শুধুই সফলতার গল্প। কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় নিয়ামুল এখন কিনেছেন একাধিক ল্যাপটপ। নলডাঙ্গার বাড়ি থেকে তিনি এই তিন ল্যাপটপে কাজ করেন। নলডাঙ্গার গ্রামে বসে নিয়ামুলের আয় এখন গড়ে মাসে প্রায় দুই হাজার ডলার—টাকার হিসাবে ২ লাখ টাকার বেশি। একই সঙ্গে নাটোরের শহীদ নজমুল হক সরকারি কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন মো. নিয়ামুল। সম্প্রতি নাটোরের মাধনগরে নিয়ামুলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

শুরুর কথা
নিয়ামুলের বাবা মোহাম্মদ হোসেন আলী প্রামাণিক ও মা রেনুকা বেগম। তিন ভাই–বোনের মধ্যে নিয়ামুল বড়। দুই বোনের মধ্যে হোসনে আরা খাতুন দশম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট বোন হুমায়রা জান্নাতের বয়স এক বছর।

নিয়ামুলের খালাতো ভাই শামসুল আলম পাশের গ্রামে বসে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতেন। এইচএসসি পাস করার পর একদিন নিয়ামুল শামসুল আলমের স্মার্টফোনে ইউটিউবে দেখেন গ্রামে বসেও বিদেশের কাজ করে আয় করা যায়। পরে নিয়ামুল স্কিলআপার নামের ফেসবুক পেজে প্রশিক্ষক শামীম হোসাইনের একটি ভিডিও দেখেন। তখন নিয়ামুলের আগ্রহ বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে বিষয়টি সম্পর্কে জানলেন।

প্রশিক্ষণ
দিনমজুরি করে ল্যাপটপ কেনার তিন মাস পর নিয়ামুল প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হন। শিখতে থাকেন ডিজিটাল বিপণনের বিভিন্ন বিষয়। প্রায় পাঁচ মাস প্রশিক্ষণ নেন নিয়ামুল। এ সময় গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিকস ও সার্ভার-সাইড ট্র্যাকিং শেখেন।

প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ২০২২ সালে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট (অনলাইন মার্কেটপ্লেস) ফাইভারে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন নিয়ামুল। ফাইভারে প্রথম গুগল অ্যাডস–সংশ্লিষ্ট একটি কাজ পান। পারিশ্রমিক ছিল ২০ মার্কিন ডলার। সময়মতো কাজটি সম্পন্ন করার পর সেই গ্রাহক নিয়ামুলকে ১০ ডলার বকশিশও দেন। নিয়ামুল বলেন, ‘তখনো কৃষিকাজ করতাম। জমিতে বসে পেঁয়াজ তুলতাম, পকেটে থাকত স্মার্টফোন। পেঁয়াজ তোলার পাশাপাশি গ্রাহকের মেসেজের উত্তরও দিতাম। অনলাইনে আমাকে সব সময় সক্রিয় থাকতে হতো।’

ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতা
ফাইভার মার্কেটপ্লেসে এখন একজন সফল ফ্রিল্যান্সার নিয়ামুল। আবার আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসেও তিনি ‘টপ রেটেড’ ফ্রিল্যান্সার। নিয়ামুল বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামে বসে এ পর্যন্ত এসেছি নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে। আজ দক্ষ হয়েছি বলেই গ্রামে নিজের বাড়িতে বসে লাখ টাকা রোজগার করতে পারছি। বাবার ধারদেনা শোধ করেছি। এখন বেশ ভালো আছি। তবে আমার একটা চাওয়া—বাইরে থেকে আমাদের টাকা (পেমেন্ট) আনার জন্য পেপ্যাল বাংলাদেশে চালু হলে খুব ভালো হয়।’

বাবার স্বপ্নপূরণ
মোহাম্মদ হোসেন আলী প্রামাণিকের স্বপ্ন ছিল একটা মোটরসাইকেলের। এই শখ পূরণ করে দিয়েছেন ছেলে নিয়ামুল। নিয়ামুলের সঙ্গে কথা বলার সময় বাবা মোহাম্মদ হোসেন আলী প্রামাণিকও এলেন। নিয়ামুলের বাবা বলছিলেন, তিনি জীবনে এমন কষ্ট করেছেন, যা ভাষায় প্রকাশও করা যায় না। পরের ভিটায় (জমি) থাকতেন। এখন নিজের জমি, নিজের বাড়ি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ আমারে অনেক কথা বলে, “তোর পোলা কী কাজ করে? বুঝিস এইগুলো? বিপদে পড়ব।” নানা মানুষ নানা কথা কয়। কিন্তু আমার পোলা (ছেলে) যেটা করে, মনে হয় ঠিক কাজই করছে। তাই পরের কথা কানে নিই না।’

গরুর খামার এবং…
নিজের আয় দিয়ে নিয়ামুল কিনেছেন কৃষিজমি ও চারটি গরু। এখন থেকে প্রতি মাসে একটি করে গরু কিনে খামারটা আরও বড় করার ইচ্ছে তাঁর। নিয়ামুল বলেন, ‘একটা বড় পরিকল্পনা আছে আমার। সেটি হলো এই মাধনগর গ্রামকে উন্নত করা। গ্রামের বেকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সামনে কাজ করার ইচ্ছা আছে। এখন গ্রামে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। তাই কাজটা সহজ হয়ে গেছে। এখন ঘরে বসেই ভালোভাবে বিদেশের কাজ করা যায়। কিন্তু এ জন্য হতে হবে দক্ষ। তৈরি করতে হবে নিজেকে। দক্ষ না হয়ে এই কাজে এলে ফলাফল হবে শূন্য।’ –সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো

 

শেয়ার করুন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
আরও পড়ুন

নতুন প্রকাশ