নিজস্ব প্রতিবেদক: ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, দেশে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীজনসহ সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।তৃণমূল পর্যায় থেকে অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়গুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
শুক্রবার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ ফাউন্ডেশন) ৬ষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২১’ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন মন্ত্রী। ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে সিসিএ ফাউন্ডেশনের মতো সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সংগঠনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি বিভাগের প্রধান মুনির হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী আনিছ, বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরামের মহাসচিব মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু ও শিশুদের সাইবার সুরক্ষা বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা প্রটেক্ট আস কিডসের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শারমিন নাহার লিনা। গবেষণা প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের রিসার্চ সেলের আহ্বায়ক এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মনিরা নাজমী জাহান।
প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯-২০২০ সালে দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন একাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। গবেষণায় এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের মতো একটি নতুন অপরাধ শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ফলে অনলাইনে কেনাকাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের তুলনায় অধিক মাত্রায় মানুষ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। গতবারের প্রতিবেদনের চেয়ে এবার এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ, যা গতবার ছিল ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের নিয়মিত জরিপভিত্তিক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয় মোট ১১টি ট্যাবে। সেখানে সামগ্রিক ফলাফলে দেখা গেছে দেশে চার ধরনের অপরাধের মাত্রা কমেছে। অন্যদিকে ছয় ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। তবে সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার পরেও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এই ভুক্তভোগীদের অভিযোগের হার হতাশাজনক। পুলিশের কাছে যাওয়ার পরও ৭২ দশমিক ২২ শতাংশ ভুক্তভোগী আশানুরূপ ফল পাননি। অপরাধের বিশ্লেষণে বলা হয়, দেশে ‘সাইবার সচেতনতা’ বাড়ানোর পাশাপাশি ‘সাইবার লিটারেসি’ও বাড়াতে হবে।
গবেষণায় সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন একাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৮.৩১ শতাংশ। যেখানে ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ১৫.৩৫ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম ছিল। যদিও ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ২২.৩৩ শতাংশ, কিন্তু এবার এই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৬.৩১ শতাংশে। অপরাধের ধরনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার। তবে এই অপরাধের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। গতবারের গবেষণায় যেখানে এই অভিযোগ ছিল ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এবার তা কমে হয়েছে ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। কিন্তু যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্ণোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির মাত্রা বেড়েছে। অপরাধের মাত্রাটি আগের ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ থেকে বেড়ে এবার হয়েছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তবে কমেছে ফটোশপে ভুক্তোভোগীর ছবি বিকৃতি করে হয়রানির ঘটনা। এই অপরাধের হার গতবারের চেয়ে এবার অর্ধেকের নিচে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশে। এদিকে অপরাধের মাত্রায় অনলাইনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দেয়ার ঘটনা এবার তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে। তবে এই অপরাধের মাত্রা গতবারের প্রতিবেদনের তুলনায় প্রায় তিন শতাংশ কমে নেমে এসেছে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশে, যা গতবার ছিল ১৭.৬৭ শতাংশ।
সুস্থ সাইবার প্রজন্ম গড়ে তুলতে অভিভাবকদের দায়িত্ব নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এজন্য তৃণমূল থেকে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, এখনো অভিভাকদের এক শতাংশও ডিজিটাল ডিভাইসের প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ব্যবহার করে না। আমরা যতবেশি ডিজিটাল হবো ততো বেশি ডিজিটাল অপরাধ বাড়বে। তাই সবাইকে এখনই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় ভাবে পুলিশের সক্ষমতা বেড়েছে। তাদের দক্ষতা বাড়লেও এই অপরাধের বিস্তার এখন গ্রামে পৌঁছে গেছে। তাই প্রতিটি থানায় অপরাধ অপরাধ শনাক্তে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়াতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে ডিজিটাল সংস্কৃতিতে নীতিবোধ জাগ্রত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন মুনির হাসান। খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। পুলিশের কাছে গিয়েও ভুক্তভোগীরা কেন প্রতিকার পাচ্ছে না বা সন্তুষ্ট নয় তার কারণগুলো খতিয়ে দেখতে হবে।
কাজী আনিছ বলেন, সরকারের দিক থেকে প্রতিরোধ বা দমনমূলক প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে সাইবার সচেতনতামূলক মডেল তৈরি করা দরকার। তাহলে সচেতনতা বাড়বে এবং অপরাধ প্রবণতা কমবে।
সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে ২০১৬ সাল থেকে পুলিশের প্রত্যেকটি বিভাগ কাজ করছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মো. মোস্তফা কামাল রাশেদ। তিনি বলেন, শিশুদের মাঝে সাইবার অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি অনলাইনে কেনাকাটা এবং গেমিং অ্যাপের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ বেড়েছে।
একইভাবে ডিজিটাল দুনিয়ায় সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মোহাম্মদ আব্দুল হক অনু। প্রান্তিক পর্যায়ে শিশুদের ডিজিটাল আসক্তি কাটাতে ভালোর জাগরণ গড়ে তুলতে আহ্বান জানান শারমিন নাহার লিনা।
গবেষণায় সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাইবার স্কোয়াড গঠন, ই-কমার্স নীতিমালা ও রাজনৈতিক জনশক্তিকে সচেতনতামূলক কাজে নিয়োজিত করাসহ নয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
(সাইবারবার্তা.কম/জেডআই/১৮ জুন ২০২১)