কাজী মুস্তাফিজ: মানুষ যখন বড় কোনো অসুখে ভুক্তভোগী হয় এবং সেটির কোনো সমাধান খুঁজে পায় না, তখনই সেটির প্রতিষেধক তৈরির প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন) গড়ার পেছনেও সে রকম একটি বিষয় জড়িত।
আমার কম্পিউটারে হাতেখড়ি ২০০১ কি ২০০২ সালের দিকে। তখন আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জনাব কাজী মফিজুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন জনাব আবদুল ওয়াদুদের একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আড্ডার ছলে কম্পিউটার শেখা। সেই থেকে কম্পিউটার সম্পর্কিত নতুন নতুন বিষয় জানার যে আগ্রহ আমার ভেতরে গেঁথে গেল সেটি এখনো চলমান। কিন্তু ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমার ইন্টারনেট ব্যবহার শেখা হয়েছে আরেকজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির কাছে। ফেনী থেকে ঢাকায় এসে প্রথম তার প্রতিষ্ঠানেই আমি কাজ শুরু করি। ছোট্ট একটি অফিসে পারিবারিক পরিবেশে আমরা তিন-চারজন কাজ করতাম। একই ছাদের নিচে এক পাশে অফিস, অন্য পাশে বাসা।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু দুই বছরের মাথায় তৈরি হয় ঝামেলা। একদিকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাসহ ক্যারিয়ারের উন্নয়নে মনমতো কিছু করতে পারছিলাম না, অন্যদিকে সেই অফিসের ‘বস’ বড়ভাইকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু টাকা ধার দিয়ে সেটি ফেরত পেতে দেখা দিলো শঙ্কা। সব মিলিয়ে সেখানে আর কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুন্দরভাবে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেব। কিন্তু তা আর হলো না। তাকে যখন জানালাম আমি চলতি ও পরের এক মাস তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করব, তারপর অন্য কাজের চেষ্টা করব, তখন তিনি এক স্তূপ অভিযোগ হাজির করলেন আমার বিরুদ্ধে। শেষে তাকে দেওয়া আমার ধার দেয়া টাকা থেকে জরিমানা বাবদ কিছু টাকা কেটে রাখলেন তিনি। অবশ্য পরে এক পর্যায়ে তার একটা অংশ ফেরতও দিয়েছেন।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আমার ফেসবুক আইডি, ই-মেইল, অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট- সব হঠাৎ হ্যাক হয়ে গেল। কোনো আইডিতেই আর লগইন করতে পারছি না। এটি ২০১০ সালের শেষের দিকের ঘটনা। তখন জনপ্রিয় একজন বাংলাদেশি মডেল অভিনেত্রীর প্রেমিকের সঙ্গে শারীরিক মেলামেশার ভিডিও ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। ওই ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয় আমার ফেসবুক প্রোফাইলেও। সিনিয়র-জুনিয়র-সমবয়সী একেকজনের একেক রকম প্রতিক্রিয়া। কী যে এক মানসিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত হলাম তা এখানে লিখে বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই। সেই যে আমাকে অনলাইনে হয়রানি শুরু, তা চলে টানা ২০১৮ সাল পর্যন্ত। আমার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া আইডি খুলে আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে যোগাযোগ, আপত্তিকর কনটেন্ট প্রচারসহ নানা অপকর্ম একের পর এক চলতে থাকে। সাইবার বুলিংয়ের ভয়াবহ দিক হলো এই মারাত্মক মানসিক যন্ত্রণা। এ ধরনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়ার ঘটনা অনেক আছে।
লাগাতার ভয়াবহ হয়রানির অভিজ্ঞতা থেকে মনে হলো আসলে আমার সচেতনতার অভাব ছিল। আমার অনলাইন আইডিগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে আমি সচেতন থাকলে এমনটা হতো না। পত্রপত্রিকার খবরাখবর ছাড়াও আশপাশে তাকালে দেখা যায় আমার মতো বহু ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত এমন ভয়াবহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ভাবলাম এ নিয়ে সবার সচেতন হওয়া উচিত। সেই ভাবনা থেকে ২০১৫ সালের ২০ মে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে সচেতনতামূলক পোস্ট শেয়ার করা শুরু করি। পত্রপত্রিকা কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে হাতের কাছে যখন যা পাই তা সেই গ্রুপে পোস্ট দিতে থাকি।
এভাবে এক বছর চলার পর কিছু মেধাবী মানুষ আমার কাঁধে হাত রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তারা হলেন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতাবৃন্দ। ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’ হলাম। একটি শিশু জন্মের পর তার সঠিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়, ঠিকমতো সেই পরিচর্যা না হলে তার সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়। এই মানুষগুলো আমার কাঁধে হাত রেখে সেই অভিভাবকত্বের দায়িত্বই হাতে তুলে নিলেন। তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয়ও ছিল না। কী অদ্ভুত, তাই না? এ জন্যই সামাজিক এই কার্যক্রম নিয়ে লিখতে বসলে প্রায়ই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। এই তো এখনই চোখের পানি টলমল করছে। কারণ সামাজিক এই কার্যক্রমকে আমার সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে করি না।
আর কয়েকটি লাইনেই লেখাটি শেষ করব। তার আগে সেসব মানুষের কথা বলতে হয় একটু, যারা একদল তরুণের সামাজিক সচেতনতামূলক কাজের গুরুত্ব বুঝে এগিয়ে এসেছেন। আমাদের সম্মানিত উপদেষ্টামণ্ডলী। ‘সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ওষুধ হলো সচেতনতা’- এই বলে তারা আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাদের মূল্যবান পরামর্শ আমাদের এই কাজকে আরো সময়োপযোগী ও গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা খুবই সৌভাগ্যবান যে, এমনসব উঁচু মাপের বিশিষ্টজনকে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদে পেয়েছি।
পরিশেষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেই শ্রদ্ধাভাজন ‘বড়ভাইয়ের’ প্রতি, যার অবদান এই সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমি অস্বীকার করতে পারব না। অবশেষে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাঁর ও তাঁর পরিবারের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করছি।
–
লেখক: কাজী মুস্তাফিজ
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, সিসিএ ফাউন্ডেশন
(২০১৮ সালে সিসিএ ফাউন্ডেশনের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রকাশনায় লেখাটি প্রকাশিত )