বুধবার, এপ্রিল ৯ ২০২৫ | ২৬শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - বসন্তকাল | ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সরকারি সেবাগুলো শতভাগ অনলাইন না হওয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি: ইকবাল হোসেন

‘সকালটাই বলে দেয় আপনার দিনটা কেমন যাবে’– প্রবাদটির বাস্তব উদাহরণ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগে যে তিনি পুরো কর্মজীবন পার করবেন, তার লক্ষণ দেখা গেছে তৃতীয় শ্রেণিতেই।  তখন ১০০ নম্বরের অংক ও ইংরেজী পরীক্ষায় ৯৯ পেয়ে তাক লাগিয়েছিলেন।  যে কার্যালয়ে প্রথম সরকারি চাকরি নিয়েছেন, সেখানকারই সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এই মানুষটিই সপ্তম শ্রেণিতে স্বপ্ন বুনেন বিজ্ঞানে পড়ার।  সেই হালও ছাড়েননি।  চাকরিজীবনের শেষ সময়ে এসেও নিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উচ্চতর ডিগ্রি।  তবে তার জীবনের পথও একদম মসৃণ ছিল না। 

 

পারিবারিক কড়া শাসনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা ইকবাল হোসেনের জীবনে কীভাবে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছে নানা অর্জন- সেসব গল্প জানিয়েছেন সাইবারবার্তাকে।  তিনি মনে করেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী ‘নতুন বাংলাদেশ’ পরিস্থিতিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, এটি ১৯৭১ সালে অর্জিত স্বাধীনতার পর থেকেই ছিল। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে  দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। ঢাকায় তার কর্মস্থলে এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

 

ইকবাল হোসেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ‘কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্স’ পদ থেকে অবসর নেন। তিনি বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক পেশাজীবীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইনফরমেশন সিস্টেম অডিট অ্যান্ড কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন (আইসাকা) ঢাকা চ্যাপ্টারের।  সংগঠনটিতে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।  এছাড়া অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিষয়ক পেশাজীবী সংগঠন ‘ইনস্টিটিউট অব ইন্টারনাল অডিটরস, বাংলাদেশ শাখার দু’বারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত অ্যাসোসিয়েসন অব সার্টিফাইড ফ্রড এক্সামিনার্স, বাংলাদেশ চাপ্টারেরও অন্তর্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নিরীক্ষা ও হিসাব, তথ্য প্রযুক্তি, ব্যবসা প্রশাসন, অর্থনীতি বিষয়ে একাধিক একাডেমিক ও পেশাগত ডিগ্রিধারী জনাব ইকবাল হোসেন একজন সত্যিকারের পেশাদার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন।

 

সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। কারো দিকনির্দেশনা ছাড়াই জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার। কিন্তু পারিবারিক নানা সমস্যায় দু’বার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। তবুও হাল ছাড়েননি। নিয়মিত অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে হয়েছেন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা।

 

:: জন্ম ও শৈশব ::  ইকবাল হোসেনের পৈত্রিক বাড়ি ফেনীতে হলেও জন্মজেলা রংপুর।  প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয় ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের চরমধুয়াই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানেই দাদির অনুরোধে চাকরী ছেড়ে বাড়ি ফিরেন তার বাবা মো. জহুর এলাহী।  তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এ কর্মরত ছিলেন।  বাবার কর্মস্থলের সুবাধেই মূলত জন্মের পরপরই রংপুরের (বর্তমানে কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর) আলো দেখার সুযোগ পান ইকবাল।

 

:: শিক্ষাজীবন :: চরমধুয়াইতে প্রথম শ্রেণির পাঠ শেষে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ফেনীর আরেক উপজেলা সোনাগাজীর চরমজলিশপুরে বিষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানেই তাঁর নানার বাড়ি। এখানকার কুঠিরহাট বাজারে ব্যবসা ছিল বাবার। ১৯৬৭/৬৮ সালের কথা, ছোট ফেণী নদীর তীরে অবস্থিত এই হাট ধান-চাল পাইকারি বেচাকেনার জন্য সুপরিচিত ছিলো।  বড় বড় পাল তোলা ও দাঁড় টানা নৌকার সমাগম ছিলো এ ব্যবসা কেন্দ্রে।

 

“বিষ্ণপুরে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিন বাংলা পড়তে দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক ফনি ভূষণ মজুমদার।  আমার পড়ায় অভিভূত হলেন শিক্ষক।  এরপর ইংরেজিও পড়তে দিলেন। আমার পড়া পছন্দ করেছেন তিনি। তখনকার দুজন নামকরা শিক্ষক আমাদের বিজ্ঞান পড়াতেন- জাকারিয়া মহিউদ্দিন ও মো. নজরুল ইসলাম।  নামগুলো এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার…।

বিষ্ণপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। এখানকার প্রধান শিক্ষক ছিলেন খায়রুল বাশার। দাগনভূঞায় বাড়ি। খুব ভালো ইংরেজি পড়াতেন। তাঁর কাছে আলাদা করে (প্রাইভেটের মতো) পড়তাম, কিন্তু টাকা নিতেন না। এমন শিক্ষক এখন পাওয়া কঠিন। আমার সঙ্গে আরও একজনকে পড়াতেন। মাহবুব ভাই। বর্তমানে জার্মানীতে থাকেন। তিনি দুজনকেই গুরুত্ব দিয়ে পড়াতেন। ইংরেজিতে রচনা মুখস্ত করতাম না, নিজ থেকে লিখতাম। হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল।  পড়াশোনার জন্য সকাল-বিকাল দুজন গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন বাবা। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সহপাঠীদের মধ্যে পড়াশোনায় প্রথম (ফার্স্ট বয়) ছিলাম।”- স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন ইকবাল হোসেন।

 

১৯৮০ সালের দিকে ফেনী সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ইকবাল।  উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সুযোগ পেলেও পারিবারিক অনাগ্রহে ফেনী সরকারি কলেজে স্নাতকে বিভাগ পাল্টে ভর্তি হন মানবিকে। স্নাতক পাশের পর ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে । এবার পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারকে আর্থিক সহায়তার দিকেও নজর দিতে হয়।

 

:: কড়া শাসনের পরিবার :: চার ভাই চার বোনের মধ্যে ইকবাল হোসেন সবার বড়। বাবার কড়া শাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তারা। বাবার মেজাজের কথা বলতেই স্মৃতি হাতড়ে ইকবাল চলে যান শৈশবে- “একদিন বাবা বাজার থেকে এসে দেখলেন আমরা পড়াশোনা করছি। একইসঙ্গে পাশে রেডিও বাজছে। সঙ্গে সঙ্গে সেটি ভেঙে ফেললেন এবং পুকুরে ফেলে দিলেন।” 

বাবার এমন কড়া শাসনের সঙ্গে পড়াশোনার প্রতি নিজের অদম্য ইচ্ছা পেশাগত জীবনের সফলতায় সহায়তা করেছে বলে জানান ইকবাল।

 

:: পেশাগত জীবন :: ছোটবেলা থেকেই কম কথা বলা মানুষটি বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে প্রকৌশলী বা চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা ঠিক করেছিলেন। কিন্তু  তার ক্যারিয়ার কোন দিকে যাবে সেই অনিশ্চয়তার দোলায় সরকারী চাকরিকেই বেছে নিয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে।  আর সরকারি চাকরির পুরো সময়ই পার করেছেন সরকারী নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগে।

 

:: চাকরি নামের সোনার হরিণের নাগাল পাওয়া যেভাবে :: স্নাতকের পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পাশাপাশি খুঁজছিলেন চাকরি। একটা চাকরি হলেও বেশি দিন করা হয়নি। শফিউল্লাহ নামে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

“আমার এক ব্যাচ জুনিয়র। ঢাকায় থাকতেন। আমরা পরস্পরকে আপনি করে বলতাম । একপর্যায়ে আমাকে ঢাকায় আসতে বললেন। আমিও রাজি হয়ে যাই। ১৯৮৫/৮৬ সালের দিকে এটি। সেই বন্ধু আমাকে দুটো টিউশনি ঠিক করে দেয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্সে ভর্তির কথা জানলাম। সেখানে ভর্তি হলাম। মহাখালী মেসে থাকতাম দুই বন্ধু। পরে ঢাবির হলে উঠেছি।  মহসিন হল, কক্ষ নম্বর ৪৩৫।  

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে হলে কোনো না কোনো ছাত্র রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ততা থাকতে হয়। আমিও ছিলা্ম একটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনে। তবে রাজনীতি মূখ্য বিষয় ছিল না। মূল লক্ষ্য ছিল হলে থেকে পড়াশোনা করা। সেখান থেকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি, প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু।” – বলছিলেন ইকবাল।

 

মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে থাকতেই রূপালী ব্যাংকে চাকরি হয়। পদ ছিল সিনিয়র অফিসার। প্রথম পোস্টিং নিজ জেলা ফেনীতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে এই নিয়োগ হয়। পড়াশোনা-চাকরি একসঙ্গে চলছিল। দুই বছর চলে এই চাকরি। চাকরি চলাকালেই সপ্তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ।

 

ফেনীতে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার প্রথম সপ্তাহেই শরীর কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হলো। টানা ৪৪ দিন ছিল এই জ্বর। এই অবস্থাতেই জানলেন বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষা শুরু হবে। শুভাকাঙ্ক্ষি এবং মা-বাবা নিষেধ করছিলেন, অসুস্থ শরীরে যেন ঢাকায় না যান। তবুও পরীক্ষায় অংশ নিতে দুর্বল শরীর নিয়ে ট্রেনে চেপে ঢাকায় আসা হলো। ট্রেন থেকে নেমেই দেখলেন ঢাকায় হরতাল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। অনেক কষ্টে হলে ফিরে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় তখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। শুধু হলগুলোতে কিছু ছাত্র অবস্থান করছিলো বিশেষ করে যারা বিসিএস পরীক্ষা দিবে তারা। দুইটি পরীক্ষা দেওয়ার পর আবার জ্বর আসে। পরে চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হন। অসুস্থতা নিয়েই বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষা শেষ করেন। এভাবে লিখিত পরীক্ষা, সাইকোলোজিক্যাল টেস্টের গণ্ডি পেরিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য (ভাইবা) নির্বাচিত হন। তখন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি)  চেয়ারম্যান ছিলেন আল হোসেনী । তার বোর্ডেই মৌখিক পরীক্ষা (ভাইবা) । ভাইবার অভিজ্ঞতা এভাবে বর্ণনা করলেন তিনি।

 

ভাইবা হলে ডাক পড়লে হলে প্রবেশ করেই জানতে পারলাম লিখিত পরীক্ষায় খুব ভালো করেছি। মনে সাহস সঞ্চার হলো। একে একে বোর্ডের সদস্যগণ নানামুখী প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একজন সাইকোলোজিস্ট থাকতেন। প্রথম পছন্দ ছিল পররাষ্ট্র, দ্বিতীয় অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস (নিরীক্ষা ও হিসাব)  ক্যাডার। কেন চয়েস দিলাম জানতে চাইলেন। প্রায় ৪০ মিনিট ভাইবা দিলাম। শেষে বোর্ডের সদস্যগণ হাসিমুখে বিদায় দিলেন। হল থেকে বের হবার তাতক্ষণিক পরেই পিয়ন দিয়ে আবার ডেকে পাঠালেন। কিছুটা ভয় পেলাম। একজন জিজ্ঞেস করলেন আমি খেলোধুলা করি কিনা। না বোধক উত্তর দিলাম। বুঝে উঠতে পারলামনা কেন এ প্রশ্ন করলেন।  বললেন তুমি ক্যাডস পড়ে এসেছোতো তাই জিজ্ঞেস করলাম। এরপর বিদায় দিলেন বিজ্ঞ সদস্যগণ।  পরে মনে হলো ক্যাডস পরে ভাইবা বোর্ডে অংশ নেয়া হয়তো ঠিক হয়নি।  যা হোক, সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় চূড়ান্তভাবে বিসিএস এ নির্বাচিত হলাম।”

 

তখন রূপালী ব্যাংকে চাকরির বয়স দুই বছর। এই চাকরি ছেড়ে অর্থমন্ত্রণালয়ে বিসিএস (অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস) ক্যাডারে জয়েন করি। সময়টা ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি।  প্রথম পদ ছিল ‘অ্যাসিসটেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল’।  প্রথম কর্মস্থল ছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাব রক্ষণ অফিস।  তিন বছর পর ‘ডেপুটি ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার’।   কর্মস্থল ছিল গাজীপুর অর্ডিনেন্স ফ্যাক্টরি।

 

:: অনিয়মের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা যেভাবে :: সরকারি ব্যয় কার্যক্রম পরিচালনা এবং এর সঙ্গে জড়িত জবাবদিহিতা  নিয়ে অডিট করাই হলো বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব ক্যাডার কর্মকর্তাদের কাজ। এখানকার কর্মকর্তাদের পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিসহ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। এই কর্তৃপক্ষের আওতায় চাকরি করতে গিয়ে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন ইকবাল।

“অনেক ধরনের অনিয়ম, অনৈতিক পেমেন্টের জন্য চাপ আসত। সেগুলো আইনগতভাবেই মোকাবিলা করেছি। সততার সঙ্গে চেষ্টা করেছি নিজেকে ক্লিন রাখার। সৎ ইচ্ছা থাকার কারণে মনোবল শক্ত ছিল। কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। ” – বলেন ইকবাল।

 

:: বিজ্ঞানে পড়ার অদম্য ইচ্ছা:: কথায় আছে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কখনো কখনো মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করলেও পারিবারিক সমস্যার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। পুরো কর্মজীবন হিসাব নিরীক্ষা পেশায় পার করলেও শৈশবের ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাল ছাড়েননি।

২০০৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে বিদেশে পড়তে যান ইকবাল। এর আগে ‘কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম’ বিষয়ে লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির অনার্সসহ বিএসসি ডিগ্রি নেন বাংলাদেশে পড়েই।  এরপর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়ে ‘সফটওয়্যার প্রকৌশল’ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ভর্তি হন।  একই ধারাবাহিকতায় ‘কম্পিউটার সিস্টেমস অডিটিং’ বিষয়ে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

 

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি পেশাগত দক্ষতায় বরাবরই গুরুত্ব দিয়েছেন ইকবাল। এরই অংশ হিসেবে নিরীক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে অর্জন করেন বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সনদ। এর মধ্যে Certified Information Systems Auditor (CISA), Certified Internal Auditor (CIA), Certified Information Security Manager (CISM), Certified Fraud Examiner (CFE) উল্লেখযোগ্য।

 

:: তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ে ভাবনা:: সরকারি নানা সেবা অনলাইন সুবিধা চালু হলেও প্রযুক্তি সুবিধায় শতভাগ আধুনিকায়ন না হওয়ায় অনিয়ম-ঘুষ-দুর্নীতি এখনও বন্ধ হয়নি বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তা।  তার ভাষ্য, এখনও আমরা অফিস-আদালতের কাজ পুরোপুরি পেপারলেস করতে পারিনি। ই-নথি, ইমেইলের ব্যবহার দপ্তরগুলোতে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বিদেশে কর্মকর্তাদের টেবিলে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছাড়া কোনো ফাইল দেখা যায় না। অথচ আমাদের দেশে ফাইলের স্তূপ পড়ে থাকে।

এখনও বিভিন্ন দপ্তরে অনলাইন সেবা চালু হওয়ার পরও ঘুষ চলছে। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতি থেকে আমরা এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে না পারা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া।

ইকবাল হোসেন মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। বিভিন্ন দপ্তরে এখনও যেভাবে তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণ করা হয়, সেটা যথাযথভাবে হয় না। নিয়মিত তথ্যপ্রযুক্তি নিরীক্ষা (অডিট) হয় না। এসব কাজে দক্ষ লোকের যেমন অভাব, তেমনি পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে এসবের প্রয়োজনীয়তা বোধ করার মানসিকতারও ঘাটতি আছে। সচেতন হলেই এসব বিষয়ে সমাধান সম্ভব। বেসরকারি খাতে যারা কাজ করছেন তথ্যপ্রযুক্তিতে তাদের সঙ্গেও সরকারের যৌথভাবে কাজ করা উচিত।

 

:: তরুণদের প্রতি পরামর্শ :: তরুণদের প্রো-অ্যাকটিভ চিন্তা করতে হবে। শুধু অ্যাকাডেমিক বিষয়ে নজর না দিয়ে দক্ষতাও বাড়ানো দরকার। আমরা মাতৃভাষা এখনো সর্বস্তরে চালু করতে পারছি না। বিভিন্ন বিদেশি শব্দের পর্যাপ্ত বাংলা পরিভাষা পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে কাজ করার আছে। আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করা দরকার।

 

:: যেমন দেশ চান :: দেশের সুশাসন নিয়ে কাজ হোক। সব প্রতিষ্ঠান দক্ষতা অর্জন করুক। সবাই নিজের স্বার্থ না দেখে জনস্বার্থ দেখলে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।

 

“১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং এ কারণে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। এখন সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর।

#

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: কাজী মুস্তাফিজ,  সম্পাদক, সাইবারবার্তা

ঢাকা, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বৃহস্পতিবার)

শেয়ার করুন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
আরও পড়ুন

নতুন প্রকাশ