সাইবারবার্তা ডেস্ক: ‘যার হাতে তুলে দিতে পারব না এই বইটা’—উৎসর্গপত্রের শেষ লাইন। বইয়ের প্রচ্ছদে হাসিখুশি তরুণের ছবি দেখে যেমন আফসোস হতে থাকে, কয়েক পাতা উল্টে উৎসর্গ দেখে মনটা হু হু করে ওঠে।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা তো ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’। এটি এমনই ভারী যে সারা জীবন চেপে থাকে মা-বাবার বুকে। তাই সালেহ উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ফাহিম সালেহ: স্বপ্নের কারিগর বইয়ের উৎসর্গে এই পিতা মার্কিন আলোকচিত্রশিল্পী অ্যালেক্স ম্যাকলিনের উদ্ধৃতি একটু বদলে লিখে যান—‘যাদের আমরা ভালোবাসি তারা দূরে চলে যায় না, তারা প্রতিদিন হাঁটে আমাদের পাশাপাশি। অদেখা, অ-শোনা, কিন্তু সব সময়ে নিকটবর্তী, খুব ভালোবাসার, খুব মনে পড়ার, খুবই প্রিয়।’ (ইংরেজি থেকে অনূদিত)।
শেষ করেন এই বাক্যে—‘যার হাতে তুলে দিতে পারব না এই বইটা।’ পিতার আকুতি এমনই। সালেহ উদ্দিন আহমদ হারিয়েছেন এমন এক পুত্রকে, যাঁর কাজ দুনিয়াজুড়ে এখন তারুণ্যের অনুপ্রেরণা। হ্যাঁ, দুনিয়াজোড়া অনুপ্রেরণাই শুধু নয়, লাখো মানুষের আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে আছে তাঁর কাজ।
বইটি তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহকে নিয়ে নানাজনের লেখার সংকলন। আমাদের দেশে বাইকভিত্তিক জনপ্রিয় সেবা পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা, ভাড়া নিয়ে বাইসাইকেল ব্যবহারের সেবা জোবাইক কিংবা প্র্যাঙ্কডায়াল, নাইজেরিয়ার রাইড শেয়ারিং সেবা গোকাডার প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহকে নিয়ে এই বই। ফাহিমকে জানার জন্য এই বই, যেটির প্রতিটি লেখা সংগ্রহ করে, নানা ধরনের ছবি যুক্ত করে শোকাহত পিতা সালেহ উদ্দিন আহমদ তুলে ধরেছেন মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নির্মম হত্যার শিকার ফাহিম সালেহকে। অন্যপ্রকাশ েথকে েবরোনো বইটির দাম ৭০০ টাকা। গত বছরের ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ম্যানহাটানে নিজের ফ্ল্যাটে ঘাতকের হাতে ঘটে ফািহমের জীবনাবসান। বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারিত-প্রকাশিত ভয়ংকর সেই হত্যাকাণ্ডের খবর যেন হিমশীতল আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় পুরো পৃথিবীতেই। যেমন বোঝা যায় তাঁর বড় বোন রুবি এঞ্জেলা সালেহর লেখায়।
রুবি লন্ডনে স্বামীর সঙ্গে অবকাশ যাপন করছিলেন। ১৪ জুলাই ২০২০। রাত ১০টা ৪৭ মিনিট। ঘুমে চোখ লেগে আসছিল। এমন সময় ফোন। নিউইয়র্ক থেকে কল করেছেন তাঁর মামি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে জানালেন, ‘ফাহিম আর আমাদের সঙ্গে নেই।’ রুবির তো বিশ্বাস হয় না। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাও শোনেন। পড়েন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। ‘সিইওকে তার ম্যানহাটানের অ্যাপার্টমেন্টে খণ্ডবিখণ্ড অবস্থায় পাওয়া গেছে।’ আরও খবর—খণ্ডিত দেহের পাশে বৈদ্যুতিক করাতও পেয়েছে পুলিশ।
ফাহিমের চেয়ে আট বছরের বড় রুবি, ‘যখন আমরা বড় হচ্ছিলাম, আমি ফাহিমের প্রতি বোনের চেয়েও মাতৃত্বের টান অধিক অনুভব করতাম। যখন সে সবে হাঁটতে শেখা বুনো বাচ্চা ছিল, তখন আমি চামচভর্তি ভাত ও মুরগির মাংস নিয়ে তার পেছনে দৌড়ে দৌড়ে খাওয়াতাম। আমি তাকে গোসল করাতাম, তার ডায়াপার পরিবর্তন করতাম এবং আমি প্রথমবার যখন তার নাক থেকে রক্তক্ষরণ হতে দেখি, তখন আতঙ্কে পাথরের মতো জমে গিয়েছিলাম।
‘তখন সে তিন আর আমার বয়স ছিল এগারো।…’ ত্রিশ বছর পর যখন বড় বোন জানতে পারলেন ফাহিমের ওপর চালানো বর্বরতার কথা, তখন তিনি এটাই বললেন, ‘ওহ্ সৃষ্টিকর্তা, আমার এই বাচ্চা, আমার অতি আদরের ছোট্ট, আমার ছোট্ট মিষ্টি ভাইয়ের সঙ্গে কে এমনটা করল? আমি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খুদে বার্তার জবাবে পাঠালাম—এটি এখনো একটি দুঃস্বপ্নের মতো, মনে হয় আমি জেগে উঠব…ওহ্! আমার অতি আদরের মিষ্টি ভাইটা।’
বোনের ভাবা সেই দুঃস্বপ্নই আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে সালেহ পরিবারের বাকি চার সদস্য—বাবা সালেহ উদ্দিন আহমদ, মা রায়হানা সালেহ, বড় বোন রুবি এঞ্জেলা সালেহ ও ছোট বোন রিফায়েত সালেহকে, যাঁদের কাছে ফাহিমের বড় পরিচয় স্নেহ-ভালোবাসার সন্তান কিংবা ভাই। সফল তরুণ উদ্যোক্তা তো বাইরের পৃথিবীর কাছে। ফাহিম সালেহ: স্বপ্নের কারিগর বইটিতে ব্যক্তি ফাহিম উঠে এসেছেন কাছের মানুষদের বয়ানে। শিশু থেকে পরিণত ফাহিমকে যেন সহজেই চেনা যায়। সালেহ উদ্দিন আহমদও তা-ই মনে করেন।
৩০ মে রাতে (ঢাকা সময়) যখন হোয়াটসঅ্যাপে নিউইয়র্কে থাকা সালেহ উদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, তখন তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। দু-এক মিনিট পরই বললেন, ‘গাড়ি থামিয়েছি। কথা বলতে পারেন।’ বললাম, পাঁচ মিনিট পর কথা বলি? পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী সালেহ উদ্দিন আহমদ মত দিলেন। কলম আর কাগজ নিয়ে আবার ফোন দিলাম। ফাহিমের মতো সন্তানহারা পিতার সঙ্গে কথা শুরু করাটা সহজ নয়। বই নিয়ে যেহেতু লিখতে হবে, তাই বই প্রকাশের কারণ জানতে চাইলাম। সালেহ উদ্দিন আহমদ বললেন, ‘মূল কারণ, আমার ছেলে সম্পর্কে সবাই যেন জানে। পরিবারের সঙ্গে তার যেমন সম্পর্ক ছিল, সে ব্যাপারে সবাই জানুক। ওর কাজ সম্পর্কে কিছুটা অনেকেই জানেন, কিন্তু ওর সম্পর্কে অতটা তো জানেন না। তাই এই বই প্রকাশের উদ্যোগ নিই আমরা। আমি নিজেকে আসলে ইনভলভ করতে চাচ্ছিলাম।’
সালেহ আহমদ বলে যান, ‘অন্যদের উপকার করার একটা মন ছিল ফাহিমের। বাংলাদেশে গিয়ে রিকশাচালকদের পানি-খাবার খাওয়াত। বস্তি দেখে ভাবত কীভাবে এসব জায়গায় মানুষ থাকে! তৈরি পোশাকশিল্প, বিশেষত রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করার চিন্তা করেছে ফাহিম। যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে সফলতা পেয়েছে একেবারে অল্প বয়সেই, কিন্তু টাকা কামানো তার উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্ভাবনী চিন্তা করত। সৃজনশীলতা ছিল ওর। আমরা কখনো কোনো সিদ্ধান্ত ওর ওপর চাপিয়ে দিইনি।’
অভিবাসী পরিবারের সন্তান ফাহিম সালেহ। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে বাড়ি সালেহ উদ্দিন আহমদের। ১৯৮৩ সালে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ফাহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালের ১২ ডিসেম্বর, সৌদি আরবের দাহরােন। আইবিএমের মতো বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সালেহ আহমদ। তাই তো স্বাভাবিক প্রশ্ন, বাবা প্রযুক্তিবিদ, সে কারণেই কি ফাহিম সালেহ প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন?
‘ঠিক তা না। ভিডিও গেম খেলত খুব। তারও আগে যে খেলনা কিনে দেওয়া হতো, সেটা ভেঙে খুঁটিনাটি দেখত। এভাবেই প্রযুক্তির প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়।’
মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘দ্য সালেহ ফ্যামিলি’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করে ফাহিম। সেই সাইটে বড় বোন সম্পর্কে লিখেছিল এমন কিছু, ‘এই হলো আমার বড় বোন, তিনি দারুণ, কিন্তু যখন আমার কাছ থেকে টিভি রিমোট ছিনিয়ে নেন, তখন আমি তাকে পছন্দ করি না।’ ফাহিম এমনই। ১৯৯৯ সালে প্রথম ওয়েবসাইট থেকে আয় করা শুরু করে। গুগল থেকে পেয়েছিল ৫০০ ডলারের চেক। তখনই কিশোরদের জন্য মনকিডু, জোকস, প্র্যাঙ্কস, ফেইক পোপ, ফার্ট স্প্রে ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন।
ফাহিম সালেহ: স্বপ্নের কারিগর-এ ২৯টি লেখা রয়েছে। লেখাগুলোতে উদ্যোক্তা ফাহিম যেমন আছেন, তেমনি আছেন ব্যক্তি ফাহিম। সালেহ আহমদের পাঁচটি লেখায় ফাহিমের নানা দিক উঠে এসেছে। এর একটা তাঁর প্রিয় কুকুর লায়লাকে নিয়ে। ২০১৭ সালে ম্যানহাটানে ফাহিম যখন বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন, সে সময় তাঁর মনে হয়েছিল পোষা এক কুকুরকে সঙ্গে রাখা দরকার। সেই থেকে সঙ্গী এই লায়লা। এখন লায়লার সঙ্গে সালেহ আহমদের অনেকটা সময় কেটে যায়, ‘লায়লার সঙ্গে আমি অনেক কথা বলি। ফাহিম আমাদের মাঝে থাকলে প্রতিদিন যে কথাগুলো ওকে বলতাম, আমি ফাহিমের ছবির নিচে বসে তা লায়লাকে শোনাই।’
ফাহিম সালেহর অনুপস্থিতি শুধু যে পরিবারকে কাঁদায় তা নয়। উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ, লেখক, ফাহিমের বন্ধু-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী—সবাইকেই ভাবায়, নির্মম হত্যায় ক্ষুব্ধ করে। লেখক তসলিমা নাসরিন এভাবে শেষ করেছেন তাঁর লেখা—‘মানুষের মতো ভালো প্রাণী জগতে কেউ হয় না, মানুষের মতো নৃশংসও কেউ হয় না।’
ফাহিম সালেহ ছবি ও কার্টুন আঁকতেন। ২০০৩ সালে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সার্স মহামারি। কার্টুন এঁকে ফাহিম সার্স ভাইরাসকে ‘সর্বকালের সেরা মহামারি’ অভিধা দেন। কার্টুনটির ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘…এই বছর ফাহিম নিশ্চয় কোভিড-১৯-কে (করোনা) দিত এই উপহার।’ ফাহিমের আঁকা ছবি আর তাঁর আইডিয়াবুকের পাতাগুলো দেখলে সৃজনশীলতার আরেকটা দিক উঠে আসে। আবার উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা, নবীনদের জন্য পরামর্শও সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে।
মৃত্যুর মাসখানেক আগে ২ জুন টুইটে ফাহিম লিখেছিলেন, ‘২০২০ নিয়ে আমার মনে প্রবল আশার সঞ্চয় হচ্ছে।’ তখন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গোটা দুনিয়াই এলোমেলো। এর আগে নিউইয়র্ক ও নাইজেরিয়া যখন করোনায় বিপর্যস্ত, তখন একটা টুইটে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর কোম্পানির এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ভালো প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু ফাহিমকেই তো থামিয়ে দিল ঘাতক। তাই তো এই বই পড়ে যেমন ফাহিমকে জানা যায়, তাঁকে বোঝা যায়, তাঁর সম্পর্কে দেশি-বিদেশি গুণী মানুষের মূল্যায়ন জানা যায় প্রতিটি পাতায়—তেমনি আহমেদ শামসুদ্দোহার আঁকা ফাহিম সালেহর প্রতিকৃতি অবলম্বনে করা প্রচ্ছদটা হৃদয়ের গভীরেই ধাক্কা দেয়। এমন হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণময় ৩৩ বছরের তরুণ—তাঁর স্মারকগ্রন্থ! মেনে নেওয়া সত্যিই কষ্টের।
এ কথা তো সত্যি, এই যুগের উপযোগী ফাহিম সালেহ বেঁচে থাকলে পৃথিবী বিশেষ করে প্রযুক্তিজগৎ আরও হয়তো দুর্দান্ত সব স্টার্টআপ পেত। ‘প্রজেক্ট রানা প্লাজা’ ফাহিমের একটা অসমাপ্ত সামাজিক উদ্যোগ। নাইজেরিয়ায় গোকাডার সাফল্যের পর করেছিলেন ফাউন্ডেশন। এমন অনেক কিছুই চলমান, কোনো কোনোটা অসমাপ্ত। সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? সালেহ উদ্দিন আহমদ বললেন, ‘আমরা একটু স্বাভাবিক অবস্থায় আসি, তারপর ওর অসমাপ্ত কাজগুলোর পরিণতি দেওয়ার চেষ্টা করব।’সৌজন্যে: প্রথম আলো
(সাইবারবার্তা.কম/আইআই/৫ জুন ২০২১)