ড. মো. নাছিম আখতার,উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়: বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মানুষের প্রায়োগিক কাজে লাগানোর উপায়কে প্রযুক্তি বলে। যেমন—পানি সেচ করা পাম্প একটি প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে জমিতে সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদন করা হয়। আদিকাল থেকে মানুষ গৃহস্থালি কর্ম, যেমন—ঘর বানানো, বাঁশ, গাছ ইত্যাদি কাটার জন্য দা ব্যবহার করে আসছে।
এই আদিম হাতিয়ারটিও কিন্তু প্রযুক্তিরই অবদান, যা মানুষের গৃহস্থালি কাজকে সহজ করেছে। আবার অনেক সময় পত্রপত্রিকার খবরে দেখা যায় এই দা দিয়েই দুই পক্ষের মারামারিতে মানুষ আহত বা হত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। তাই বলা যায়, প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য আবিষ্কৃত হলেও এর অপব্যবহার মানুষ, সমাজ, জাতি তথা দেশকে বিপন্ন করতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকে করেছে সহজ থেকে সহজতর।
তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করেই জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। যাকে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলছি। জ্ঞানের সমৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও ব্যবহার তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষক ছাড়াও একজন আগ্রহী ব্যক্তি কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য অবারিত সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তির সুবিধাটি যখন একজন অসৎ ও অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির দ্বারা নেতিবাচকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখনই এর অপব্যবহারে সমাজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে।
করোনা মহামারিতে মানবজাতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকালে ঘরে বসে মানুষ তার অবসর সময়ের বেশির ভাগটাই ব্যয় করছে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে। যার ফলে দেখা দিচ্ছে নানা মানসিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতা অনেক সময় মানসিক রোগে পরিণত হচ্ছে। আমরা জানি, মানুষের আনন্দ বা সুখের হরমোনগুলোর নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে দরকার খেলাধুলা, শরীরচর্চা ও কায়িক পরিশ্রম। কিন্তু বর্তমান সমাজের জীবনব্যবস্থা হয়ে পড়ছে সম্পূর্ণ বিপরীত।
মানুষ খেলাধুলা, শরীরচর্চা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মোবাইল বা কম্পিউটারে সময় কাটাচ্ছে। যার ফলে শরীরে হরমোনের অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ হয়ে পড়ছে বিষাদগ্রস্ত, অলস ও কর্মবিমুখ। রাত জেগে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর ফলে পরিমিত ঘুম হয় না। এতে শরীরে বাড়ছে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা, যা মানুষকে ধৈর্যহীন, খিটখিটে মেজাজের জীবনযাপনের পথে পরিচালিত করছে।
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীরা দূরশিক্ষণ সুবিধা নিতে দিনের বেশির ভাগ সময়ই কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার দোহাই দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন ইন্টারনেট গেম এবং হাস্যরসাত্মক ভিডিও বা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। নানা চেষ্টা করেও অভিভাবকরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। গবেষণা বলছে, কভিড-পরবর্তী সময়ে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহার করছে, ঝুঁকছে পর্নোগ্রাফির সাইটেও।
মনোবিজ্ঞানী ও সাইকিয়াটিস্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকার কারণে এবং স্মার্টফোনের অপব্যবহারের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসছে। এমন পরিস্থিতি একদিকে যেমন তাদের স্বাভাবিক মানসিক গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে রাত জেগে অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।
অনলাইন গেম শিশু-কিশোরদের শুধু মানসিকভাবে নয়, নৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। খেলার নেশায় কোমলমতি তরুণরা মা-বাবার পকেট পর্যন্ত কাটছে। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের মুদির দোকান আছে। তিনি ছেলেকে নিয়ে তাঁর দুঃখের কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করলেন এবং পরামর্শ চাইলেন।
তিনি জানালেন, বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছেন পকেটে টাকা রাখলে টাকা কমে যায়। পরে অনুসন্ধানে বের হলো, তার অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে অনলাইন গেমে বুলেটপ্রুফ পোশাক ও হেলমেট কেনার জন্য বাবাকে না বলেই এই টাকা নিয়ে বিকাশের মাধ্যমে খরচ করছে। একজন অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া শিক্ষার্থী কিভাবে নিজের অজান্তেই ভার্চুয়ালজগতের খেলাকে কেন্দ্র করে পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ভেবেছেন কি! এটি একটি মাত্র ঘটনা। এমন সমস্যায় পতিত বাংলাদেশের লাখো পরিবার।
সোশ্যাল মিডিয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা গুপ্তঘাতকের ভূমিকায় নিঃশব্দে নিজেদের কাজ পরিচালনা করছে। কোমলমতি তরুণ-তরুণীর মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তারা হোম ডেলিভারি ভিত্তিতে নিশ্চিন্তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এলএসডি, আইস, গাঁজার কেক ইত্যাদি মাদক এই সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীর হাতে পৌঁছে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে নিঃসন্দেহে দেশের যে নবপ্রজন্ম নিয়ে আমরা আশাবাদী, তাদের ভবিষ্যৎ তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে বলে আমার বিশ্বাস। টিকটক ও লাইকির মতো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন প্রগ্রামগুলো ব্যবহার করে অশ্লীলতার মধ্যে প্রবেশ করছে এ দেশের তরুণ-তরুণীরা। সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রকাশ—টিকটকের নায়িকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় অনেক তরুণীকে পাচার করা হয়েছে বিদেশে।
লাইকি-বিগো লাইভের মাধ্যমে প্রতি মাসে বিদেশে শতকোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এসব অ্যাপ দিয়ে ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের জন্য প্রয়োজন হয় ডায়মন্ডের। ডায়মন্ড হলো ভার্চুয়াল মুদ্রা। এসব অ্যাপ ব্যবহারকারী লক্ষাধিক বাংলাদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইন ব্যাংকিং, হুন্ডি, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও ব্যাংকের মাধ্যমে ডায়মন্ড কিনছে। ফেসবুক গ্রুপকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সমাজে ঘটাচ্ছে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যা দেশের নীতিনির্ধারক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি।
তথ্য-প্রযুক্তি ছাড়া বর্তমান পৃথিবী প্রায় স্থবির। তাই মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে কোনো সমাধান আসবে না। ব্যবহারকারীদের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক দিক বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রলোভন ও প্রতারণার ফাঁদের কথা এবং এর ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে টেলিভিশন, রেডিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা জরুরি।
সন্তানদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে-মেয়েরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করছে ভার্চুয়ালজগতে সে সম্পর্কে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মা-বাবাকে সন্তানের সঙ্গে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যাতে তারা বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আশ্রয় না খোঁজে। এর পরও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে হতে হবে সাইবার অপরাধ দমনে সদাসতর্ক। তবেই গড়ে উঠবে প্রযুক্তির সুবিধাভোগী সুস্থ, সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতি।
(সাইবারবার্তা.কম/আইআই/১৯ জুন ২০২১)