সাইবারবার্তা ডেস্ক:
একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবিগুলো ছিল নিজের ফোনে। ইমেইল কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে কারো সঙ্গে সেগুলো শেয়ার করা হয়নি। ফোন হ্যাকও হয়নি। এমনকি ফোনটি কেউ চুরিও করেনি। এরপরও সেই ছবিগুলো কিভাবে অন্যের হাতে চলে গেলো! আর সেই ছবিকে পূঁজি করে রীতিমতো চলে মানসিক হয়রানি। ঢাকার এক তরুণী এমন বিড়ম্বনায় পড়েছেন। টাকা দিয়ে রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সেবা নিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হন তিনি। তার সেই অভিজ্ঞতার পুরো গল্প থাকছে এই বিশেষ প্রতিবেদনে-
ঢাকার উত্তরায় আত্মীয় বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ফেলে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। ধানমন্ডিতে নিজের বাড়িতে ফিরে ওই আত্মীয় বাড়ি থেকে সেই ফোনটি আনতে তিনি পাঠাও রাইডের সেবা নেন।
পাঠাওয়ে বুকিংয়ের পর উত্তরা হতে ধানমন্ডিতে মোবাইল ফোনটি আসতে সময় লাগে তিন ঘণ্টারও কম। অতিপ্রয়োজনীয় বস্তুটি হাতে পেয়ে স্বস্তি ফেরে সাদিয়া (ছদ্মনাম) নামের ওই তরুণীর।
তবে কিছুদিনের ব্যবধানে সাদিয়ার সব স্বস্তি কেড়ে নেয় ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি আইডি থেকে আসা তার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ছবি। সাদিয়া বুঝতে পারেন ছবিগুলো তার নিজের। তিনি ব্যক্তিগত ছবি তুলে নিজের মোবাইলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। এই ছবি কারো সঙ্গে শেয়ার করেননি। এমনকি তার মোবাইলটিও কারো হাতে দেননি।
ছবিগুলো সাদিয়াকে দিয়ে ওই আইডি থেকে টাকা দাবি করা হয়। চাহিদা মতো টাকা না পেলে আইডির পেছনে থাকা ব্যক্তি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন।
উপায়ান্তর না দেখে সাদিয়া ইসলাম কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ করেন। অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিট। এরপর তদন্তে যা উঠে আসে তাতে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম।
ক্লুলেস এমন অভিযোগের বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সিটি-সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ বলেন, সাধারণত যেসব অপরাধের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে সাইবার ক্রাইমের অপরাধগুলো একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, কিছু দিন আগে একজন নারী ভুক্তভোগী আমাদের কাছে একটি অভিযোগ করেন। তার মোবাইল থেকে কিছু ব্যক্তিগত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কিছু অপরাধী তাকে জানিয়েছে তাদের কাছে আরো ছবি আছে। অভিযোগে ওই নারী জানিয়েছেন ছবিগুলো তার একন্তাই ব্যক্তিগত। কারো সঙ্গে সেগুলো শেয়ার করেননি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারো কাছে পাঠাননি। অভিযোগের বিষয়টি আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ছিল।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, সামনে কিছু প্রশ্ন আসে। তিনি ছবি কাউকে পাঠাননি, সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছিল না। ছবিগুলো শুধু মাত্র তার মোবাইলেই ছিল। সেই মোবাইল কোথাও ঠিক করতেও দেননি বা কোনো ব্যক্তির হাতে তিনি মোবাইল দেননি। আবার যে লোকগুলো তাকে ব্লাকমেইল করছিল তারাও কোনোভাবে ওই নারীর সঙ্গে পরিচিত না। এমন কি কখনো কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না। তাহলে প্রশ্ন হলো কিভাবে ছবিগুলো তাদের হাতে গেল! ফলে আমদের কাছে ঘটনাটি একদম ক্লুলেস কেস মনে হয়েছে।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ বলেন, পরবর্তীতে আমরা ভিক্তটিম ওই নারীর সঙ্গে আলোচনায় বসি। তার বিগত সময়ের কিছু কর্মকাণ্ড জানার চেষ্টা করলাম। তার সঙ্গে আলোচনার পরে ছোট একটি বিষয়ে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করি। আর সেটি হলো তার আত্মীয়ের বাসায় একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে তার ওই আত্মীয়ের বাসায় মোবাইলটি ফেলে এসেছিলেন। সেই বাসা থেকে তার মোবাইলটি ফেরত আনা হয় একটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কুরিয়ার রাইডারদের মাধ্যমে। আমাদের এই বিষয়টি সন্দেহ হয়। যদিও সাধারণত কুরিয়ারের মাধ্যমে কোনো পণ্য পাঠানোর আগে কিছু নিয়মনীতি মানতে হয়। যার অন্যতম একটি হচ্ছে যেকোনো পণ্য পাঠানোর সময়ে ভালোভাবে প্যাকিং করে পাঠাতে হয়। আমরা অভিযোগকারীর আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তিনি মোবাইলটি পাঠানোর আগে ভালোভাবে প্যাকিং করে দিয়েছেন। ভেতরে যে মোবাইল আছে সেটি বোঝার উপায় ছিলো না।
পরে আমরা পণ্য পৌঁছে দেয়া ওই প্রতিষ্ঠানের যে কর্মী উত্তরায় সাদিয়ার আত্মীয়ের বাসা থেকে মোবাইলটি রিসিভ করেছিলেন ও ধানমন্ডিতে যে রাইডার পণ্যটি পৌঁছে দিয়েছিলেন তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করি। তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে আমাদের কাছে বেশ কয়েকটি বিষয়ে সন্দেহ মনে হয়। তখন আমাদের মনে হয়, হয় তো তারা যাত্রা পথে মোবাইলটি চালু করার চেষ্টা করেছে এবং মোবাইল থেকে ছবি সরিয়ে নিতে পারে। বিষয়টি আরো পরিস্কার হতে আমার এই দুইজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন জব্দ করার পরে সেখানে আমরা বেশ কিছু তথ্য পেয়ে গেলাম।
পরে তাদের দেয়া তথ্য মতে যানা যায়, যে ছেলেটি উত্তরা থেকে মোবাইলটি সংগ্রহ করেছিল সে অফিসে এনে তা আরেকজনকে দিয়ে ধানমন্ডিতে ডেলিভারি দেয়ায়। ধানমন্ডিতে ডেলিভারি করার সময়ে রাইডার কৌতুহলবশত প্যাকেটটি খোলে এবং সে বিভিন্নভাবে চেষ্টার পরে মোবাইলের লকটি খুলতে পারে। যেহেতু মোবাইলটিতে দুর্বল একটি লক ছিল তাই সহজেই সে মোবাইলে থাকা ব্যক্তিগত ছবি নিজের মোবাইলে নিয়ে নেয়। এছাড়া মোবাইলে থাকা ওই নারীর ফেসবুক আইডির তথ্য জেনে নেয়। পরবর্তীতে সে আরেকটি ফেইক আইডি খুলে সেটি দিয়ে অভিযোগকারী নারীর ফেসবুকে ম্যাসেজ দিয়ে ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করে। নির্দিষ্ট অংকের টাকাও দাবি করে।
পরে রাইডশেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের ওই দু্ই কর্মী স্বীকার করে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মোবাইলে ওই নারীর বেশ কিছু ছবি ব্যক্তিগত ছবি পাওয়া যায়। পরে তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। এখন তারা কারাগারে।
কুরিয়ারে পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে আরো সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনা সাধারণ চোখে দেখলে মনে হবে কোনো অপরাধ ঘটেনি। মোবাইল চুরি হয়নি, ফেসবুক হ্যাক হয়নি। কিন্তু ছোট একটি বিষয় একজন মানুষের জন্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটির উদাহরণ এই ঘটনা।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, কুরিয়ার সার্ভিস সেবা অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে আছে। তবে আধুনিক যুগে কুরিয়ার সেবার মান ও প্রতিষ্ঠান বেড়েছে। শহরের মধ্যে যারা পণ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে। এগুলো আসলে কুরিয়ার সার্ভিস না। এগুলো রাইড শেয়ারিং। তারা তাদের মূল কাজের বাইরে পণ্য পৌঁছে দেয়ার ভালো পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তারা রাইডার নিয়োগের ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই না করার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান রাইড করতে জানলেই বা লাইসেন্স থাকলেই লোক নিয়োগ দিয়ে দেয়। তাদের বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেয় না। নিয়োগ পদ্ধতি আরো স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
তার পরামর্শ, কুরিয়ার বা এই ধরনের সেবার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বা মূল্যবান পণ্য না পাঠানোই উত্তম। অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। ‘আমি বলবো মূল্যবান পণ্য নিজ হাতে পৌঁছানোই ভালো। ছোট একটি ভুল সামাজিক ও পারিবারিক জীবন দূর্বিসহ করে তুলতে পারে। তবে সাধারণ পণ্য বা ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে কুরিয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে।’ বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সৌজন্যে: ঢাকাটাইমস, প্রতিবেদক আল-আমিন রাজু।