:: সাইবারবার্তা ডেস্ক ::
নিম্নমধ্যবিত্ত এক পরিবারে মা–বাবার ষষ্ঠ সন্তান মো. সাইফুর রহমান। কাছের মানুষের কাছে সোহাগ। বেড়ে উঠেছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বেশীনগর গ্রামে। বাবা সৌদিপ্রবাসী। গ্রামের ধুলোমাটি–কাদায় বড় হতে হতে সাইফুর উপলব্ধি করেছিলেন, অন্য সবার বাবার মতো তার বাবা যখন–তখন এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন না। যদিও বড় চার বোন ও এক ভাইয়ের আদর–স্নেহে ঘাটতি হয়নি কোনো দিন।
অনেক বড় সংসার হলেও তখন পর্যন্ত অভাব–অনটনে ভুগতে হয়নি তাদের। বেশ সুন্দরভাবেই চলছিল জীবন। সেই সুন্দর জীবনে প্রথম ধাক্কাটা আসে ২০১৭ সালে, যখন এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন সোহাগ। সে সময়েই হঠাৎ প্রবাসী বাবা দেশে ফিরে এলেন। এসব ঘটনার ফলাফল হিসেবে সোহাগকে কুমিল্লার একটি তেল কারখানায় চাকরি নিতে হয়। খুব সামান্য বেতন। তবে সোহাগ চাইছিলেন নিজের মতো করে কিছু করতে।
২০১৮ সালে বড় ভাই ও বন্ধুর পরামর্শে চাকরি ছেড়ে কুমিল্লা থেকে কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেন। ৯০ দিনের ফ্রিল্যান্সিংয়ের কোর্সে ভর্তি হন স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে। এ সময় নিজের একটা কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? কিছুতেই টাকার সংস্থান হচ্ছিল না। সমর্থন পাওয়া যাচ্ছিল না ভাইবোনদের কাছ থেকেও। হতাশ হয়ে পড়েন সোহাগ। একদিকে প্রশিক্ষণ চলছে, কিন্তু একটি ল্যাপটপ বা কম্পিউটার না থাকায় অনুশীলন করতে পারছেন না। অনেক বুঝিয়ে বড় বোনকে ২০ হাজার টাকা দিতে রাজি করাতে পারেন। সেই টাকায় ল্যাপটপ কেনেন। কিন্তু তত দিনে প্রশিক্ষণ প্রায় শেষ। কিছুই শেখা হলো না সোহাগের।
এ পর্যায়ে স্থানীয় এক বড় ভাইয়ের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু সেই বড় ভাইয়ের নানা ব্যস্ততার কারণে ঠিকমতো শেখা হলো না কিছুই। গেলেন আরেক স্থানীয় বড় ভাইয়ের কাছে। যেহেতু আগে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সোহাগ, তাই বুঝতে পারলেন, ওই বড় ভাইয়ের নিজের কোনো ব্যাপারে দক্ষতা নেই। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তিনি শুধু মুনাফা গোনেন। এভাবে কখনো কোনো প্রশিক্ষণকেন্দ্রে, কখনো নিজের প্রচেষ্টায় দিনের পর দিন লেগে থেকে কাজ শিখতে সক্ষম হন সোহাগ। এই পর্যায়ে তিনি ছয় মাস ধরে গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিটিকস শেখেন। আরও ছয় মাস চর্চা করেন। ফেসবুক অ্যাডস বিষয়টিও রপ্ত করেন এ সময়। নিজের মনোবল ধরে রাখাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। পরিচিত অনেকেই সোহাগের এই লেগে থাকাকে পাগলামি মনে করতেন। কিন্তু তিনি লেগে রইলেন। প্রাথমিকভাবে সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা এসইওর কাজও শিখে ফেললেন সোহাগ। ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট বা অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভআরে নিজের অ্যাকাউন্ট খুললেন। কিন্তু বিপাকে পড়লেন ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে প্রথম তো একজন গ্রাহককে গুছিয়ে বলতেই পারলেন না যে তিনি তার কাজটা করে দিতে পারবেন। আবার হতাশা।
এবার সোহাগ নিজেকে বোঝালেন, ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই। ঠিক করলেন, ইংরেজিতে দুর্বলতা কাটাবেন। কিছুদিন নিজের সঙ্গে নিজেই ইংরেজিতে কথা বলতে লাগলেন। এরপর বন্ধুদের সঙ্গেও। ভুল হলেও ইংরেজিতে কথা বলা বন্ধ করেননি তিনি। সোহাগের একজন গ্রাহক অনেক সাহায্য করেছেন। ভাষার জড়তা কাটানোর জন্য প্রায় প্রতিদিন ভাঙা ভাঙা ইংরেজি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইনে মিটিং করেছেন দুজন। প্রায় এক মাস পর স্টিভ নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের কাছ থেকে সোহাগ ২০ ডলারের একটি অর্ডার পেলেন। স্টিভ তাঁকে ফাইভ স্টার রেটিং দেন, সেই সঙ্গে ইতিবাচক মন্তব্য করে অনুপ্রেরণা জোগান। এখানেই থেমে থাকেননি স্টিভ। সোহাগের কাজের ত্রুটিগুলো দূর করতে তিনি তাকে আরও ২০ ডলারের বিনিময়ে নিয়োগ করেছিলেন।
এ ঘটনার এক মাসের মাথায় সোহাগ একটি প্রতিষ্ঠানে মাসে ১৫০ ডলার বেতনে ৬ মাসের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। যদিও তারা তাঁকে এক মাসের বেশি সুযোগ দেয়নি। ওই সময়ে আরও কিছু গ্রাহকের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ করেন তিনি। মাত্র দুই মাস কাজ করে ‘লেভেল ওয়ান সেলার’ স্ট্যাটাস পান। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে তাঁর ওই আইডি বাজেয়াপ্ত হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী আয়ও হচ্ছিল না দেখে পরিবারের সদস্যরা তাকে চাপ দিচ্ছিলেন, তিনিও যেন বিদেশ চলে যান। আবারও হতাশা ভর করে। হতাশায় দিশাহারা হয়ে পড়েন সোহাগ, তবে হাল ছাড়েননি।
২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর লোপাস রোগে প্রিয় বন্ধুকে হারান সোহাগ। এ ঘটনাটি তাঁর মনে ভীষণ নাড়া দেয়। একরকম স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। সব ছেড়ে একেবারে দিশাহীন হয়ে পড়েন। সার্চ ইঞ্জিন বিপণনের (এসইএম) মতো বিষয় নিয়ে লেগে থাকেন। টানা এক বছর চেষ্টা করেন নতুন নতুন বিষয়ে নিজের জানাশোনার পরিধি বাড়ানোর। সোহাগের পেশাজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় ছিল করোনাকাল। বিশ্বজুড়ে লকডাউন। ২০২০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি স্কিলআপার ফর ডিজিটাল স্কিলস নামে একটি গ্রুপ দেখতে পান। গ্রুপে সাধারণ একজন সদস্য হিসেবে যোগ দেন। গ্রুপের পোস্টসহ বেশ কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখা শুরু করেন।
সোহাগের মনে হয়, এত দিনে তিনি একটি সঠিক মাধ্যম খুঁজে পেয়েছেন। যেখানে গুগল অ্যাডসের বিস্তারিত জানতে পারবেন। সোহাগ বলেন, ‘কালবিলম্ব না করে গ্রুপ অ্যাডমিনকে ফোন করি। কিছুক্ষণ পর অপর প্রান্ত থেকে আমার ফোন ধরেন স্কিল আপারের প্রতিষ্ঠাতা শামিম হুসাইন। তাঁকে নিজের আগ্রহের কথা জানাই। শামীম হুসাইন গুগল অ্যাডসের কোর্সটি করার পরামর্শ দেন।’ এরপর গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিটিকস—এই দুটি কোর্সে ভর্তি হয়ে যান। দুই মাসে সম্পন্ন করে ফেলেন কোর্স। তারপর বিভিন্ন কাজ মার্কেটপ্লেসে তুলে ধরেন তিনি। মাত্র ১২ দিনের মাথায় সোহাগের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। একজন মার্কিন গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর, যা ছিল এক চমকপ্রদ ঘটনা। ওই গ্রাহকের কাছ থেকে মাসিক ৫৫০ ডলার চুক্তিতে গুগল অ্যাডের কাজ করে নিজের হাত পাকান তিনি।
কিছুদিন পর স্কিলআপার গ্রুপে গুগল অ্যাডস ও গুগল অ্যানালিটিকসের লাইভ কোর্স সম্পন্ন করেন সোহাগ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি এখন ফাইভআর ও আপওয়ার্কের টপ রেটেড সেলার। তাঁর মাসিক আয় প্রায় তিন হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিন লাখ ৬৬ হাজার)। নিজের একটি এজেন্সিও খুলেছেন সোহাগ। সাতজন কর্মী কাজ করেন সেখানে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে সদ্য স্নাতকও শেষ করেছেন। চেষ্টা করেছেন উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে যাওয়ার। সাইফুর রহমান সোহাগের স্বপ্ন এখন গ্রামের অসচ্ছল যুবকদের জন্য কিছু করা।
সোহাগ বলেন, ‘নিজ গ্রামে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছি—একটি খামার, যেখানে ২০ জনের কর্মসংস্থান হবে। আর ২০টি কম্পিউটার দিয়ে একটি উন্মুক্ত সাইবার ক্যাফে কাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রও খুলতে চাই, যেখানে গ্রামের তরুণ–যুবকেরা বিনামূল্যে একই সঙ্গে কাজ শিখতে ও করতে পারবে।’
যারা ফ্রিল্যান্সিং করতে চান তাদের জন্য সোহাগের পরামর্শ—সমাজের নেতিবাচক কথায় কান না দিয়ে ধৈর্য ও অধ্যবসায় সহকারে কাজ করতে হবে। তাহলেই আসবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা। -সৌজন্যে: প্রথম আলো
(সাইবারবার্তা.কম/২৭জানুয়ারি২০২৫/১৪৫১)