বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ-উল বারী এ বিষয়ে গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। ২০১০ সালের ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন’ বাতিল ছাড়াও ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে যেসব বিধি-বিধান রয়েছে সেগুলো বাতিল এবং টেলিযোগাযোগ সেবার সঙ্গে ডিজিটাল সেবা যুক্ত করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের সংস্কার প্রত্যাশা করছি আমরা।
বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের আগে ২০০১ সালের মূল আইনের ৩১ ধারায় কমিশনের ক্ষমতা বিষয়ে বলা ছিল, কমিশন টেলিযোগাযোগ সেবা বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স প্রদান, তা বাতিল করা, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, টেলিযোগাযোগ সেবার ট্যারিফ, কলচার্জ নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। কিন্তু এই ক্ষমতা খর্ব করে ২০১০ সালের সংশোধিত আইনে লাইসেন্স প্রদান ও তা বাতিল করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান করা হয়। এর ফলে টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও লুটপাট শুরু হয়।
মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ-উল বারী এ বিষয়ে বলেন, ‘লাইন্সেন্স এখনো বিটিআরসি থেকেই ইস্যু করা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১০ সালে বিটিআরসির ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করার পর ২০২০ সালের শেষ দিকে এই স্বাধীন কমিশনের স্বাধীনতাই কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। সরকারের এই বিভাগ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের জন্য আবারও যে খসড়া প্রস্তুত করে তাতে বিটিআরসি বিষয়ে বিদ্যমান ‘একটি স্বাধীন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে লেখা হয় ‘সরকারের একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা’। ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’ শব্দ দুটি বাদ দিয়ে লেখা হয় ‘সরকারের একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা’। বিদ্যমান আইনের ২১ ধারায় টেলিযোগাযোগ খাত থেকে আয় বিটিআরসির নিজস্ব তহবিলে জমা রাখার বিধান আছে। সেটি সংশোধন করে সরকারি কোষাগারে জমার বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া বেতার ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ, এর ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান, বেতার ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের পরিবীক্ষণ ও স্পেকট্রাম ব্যবস্থাপনায়ও সরকারের অনুমতি নেওয়ার বিধান রাখা হয়। সংশোধিত এই আইনের খসড়া সম্পর্কে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে বিটিআরসির মতামত চাওয়া হলে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বিটিআরসির চেয়ারম্যান মো. জহিরুল ইসলাম সে সময় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেলিযোগাযোগ আইন এভাবে সংশোধন করা হলে বিটিআরসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে আমলাতন্ত্রের কবলে পড়বে টেলিযোগাযোগ খাত এবং এর নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা থাকবে না।’
তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের অধীনে রয়েছে বিটিসিএল, টেলিটকসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেনি। বিটিআরসি বিটিসিএলের কাছে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং টেলিটকের কাছে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাবে। সেই টাকা এই দুটি প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করছে না। এ অবস্থায় বিটিআরসির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলে গেলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
বিটিআরসি যে কারণে বর্তমান আইন বাতিল চায় : বিটিআরসির গত ১৬ এপ্রিলের চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর অধীনে গঠিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন স্বাধীন সত্তাবিশিষ্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে শুরু থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছে। সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন ও তত্সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগের তথা টেলিযোগাযোগ খাতে সম্পদের সুষম বণ্টন এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করা অপরিহার্য, যা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত শতাধিক সদস্য রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করেছে। এর ধারাবাহিকতায় প্রারম্ভ থেকে ২০১০ সালে ওই আইনের সংশোধনীর আগ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশন ভূমিকা পালন করে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।’
চিঠিতে আরো বলা হয়, দ্রুত পরিবর্তনশীল টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা, নির্দেশিকা, গাইডলাইন ইত্যাদি প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক। কিন্তু আইনটি ২০১০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সরকারের পূর্বানুমোদনসংক্রান্ত বিধান সন্নিবেশ করার ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে, যা এই খাতে সুষ্ঠু বাজার নিয়ন্ত্রণের অন্তরায়। এ অবস্থায় নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান ও গতিশীলতা আনার জন্য ২০১০ সালের সংশোধনী বাতিল করা প্রয়োজন।
বাতিল করার তিনটি কারণ সম্পর্কে চিঠিতে বলা হয়, ২০১০ সালের সংশোধনীর পরিপ্রেক্ষিতে টেলিযোগাযোগ সেবার জন্য লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, লাইসেন্সের নাম পরিবর্তন এবং ট্যারিফ অনুমোদনসহ বিভিন্ন অপারেশনাল কার্যক্রমে সরকারের পূর্বানুমোদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বিটিআরসির নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যসম্পাদনে দীর্ঘসূত্রতার এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের সঠিক কাঠামোর বাইরে নেতিবাচক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আইন এবং সরকার প্রণীত নীতিমালা অনুসারে বাজার নিয়ন্ত্রণে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনার জন্য রেগুলেটর হিসেবে সরকারের পূর্বানুমোদন গ্রহণের বিষয়টি বিটিআরসির স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার ক্ষমতা খর্ব করছে। ফলে টেলিযোগাযোগ খাতে একটি অসম বাজারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যা বৈশ্বিক প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের সুযোগ ব্যবহার করে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় টেলিযোগাযোগ শিল্পের পুনর্বিকাশের পথে অন্তরায়। এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালে অন্তর্ভুক্ত সরকারের পূর্বানুমোদনসংক্রান্ত বিধানাবলি বাতিল করা অপরিহার্য।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে—বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্প্রতি আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধের সংস্কৃতি এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের ঘাটতি বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্যও সংশ্লিষ্ট আইনে এ ধরনের সুযোগ রহিত করা আবশ্যক।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে—বর্তমান ডিজিটাল যুগে ওটিটি, কনটেন্ট সেবা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের যোগাযোগ, বিনোদন, ব্যবসা এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে টেলিযোগাযোগ শিল্পকে ডিজিটাল সেবাবান্ধব খাত হিসেবে গড়ে তোলা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে বিদ্যমান আইনকে পরিশীলনের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সেবাকে আধুনিক, অর্থবহ, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ ডিজিটাল সেবার সহায়ক ভূমিকা পালনের উপযোগী করে তোলা অপরিহার্য। – সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ