২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের অরিগনে স্থাপিত লাইগোর শনাক্তকারক যন্ত্রে একটা সংকেত আসে। তিন মিনিটের মধ্যে বিজ্ঞানীরা তা জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ই-মেইল চালাচালি। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়ে যান, এটা পৃথিবীর নিজস্ব কোনো তরঙ্গসংকেত নয়। বরং ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মিলনে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গেরই সংকেত। এর মাধ্যমে ১০০ বছর আগে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের বলে যাওয়া তরঙ্গের কথা সত্যি প্রমাণিত হয়। এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার কাজে অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইগোর বিজ্ঞানী দলে ছিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই।
বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদারের জন্ম ১৯৭৭ সালে, বরগুনায়। ছোটবেলায় তাঁদের সংসার ছিল টানাটানির, তিন বেলা ভাত জোটানোই ছিল মুশকিল, লেখাপড়া তো ছিল দূরের কথা। দীপঙ্করের বড় ভাই শংকর তালুকদার রাস্তার ধারে বসে চাল বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তিনি নিজেও মাথায় করে কাঁঠাল বিক্রি করেছেন পড়ালেখা আর সংসার খরচ চালানোর জন্য। সংসারের এই অনটনের মধ্যেই বরগুনা আদর্শ স্কুল, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বরগুনা জিলা স্কুল আর বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষে (২০০২) মাস্টারমাইন্ড আর অক্সফোর্ড স্কুলে পড়িয়েছেন কিছুদিন। তারপর কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। সেখানে অ্যাডভান্সড ম্যাথমেটিকস পড়েছেন কেমব্রিজে (২০০৩)।
এরপর ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্নাতক পড়ার অংশ হিসেবে এক বছর কাটিয়েছেন জার্মানির হ্যানোভারের আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউটে। সেখানে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল, ‘আকাশের স্থানীয় অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল উত্সসমূহ থেকে কীভাবে দীর্ঘকালীন মহাকর্ষ তরঙ্গ খোঁজা যায়’। সেখান থেকে ফিরে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৃতীয় মাস্টার্স। ২০১২ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেন। তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয়ও ছিল, দুটি ব্লাকহোল মিলিত হলে যে অশান্ত ব্লাকহোল তৈরি হয়, সেখান থেকে আসা মহাকর্ষ তরঙ্গের সংকেত কীভাবে শনাক্ত করা যাবে। ২০০৭ থেকে দীপঙ্কর মহাকর্ষ তরঙ্গ গবেষণা শুরু করেন। লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের সদস্য হন ২০০৮ সালে। এ মুহূর্তে তিনি অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের হয়ে কাজ করছেন।
সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন আমাদের বিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। শত ব্যস্ততার মাঝেও ‘প্রশ্ন কার্যালয়ে ছোট্ট একটি সাক্ষাত্কার দিতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। সেই সাক্ষাত্কারের চুম্বক অংশ এখানে ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম।
প্রশ্ন: মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ার পরে ব্যক্তিগতভাবে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
দীপঙ্কর তালুকদার: আমি প্রায় নয় বছর লাইগো প্রজেক্টের পেছনে ব্যয় করেছি। শিক্ষার্থী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। তখন পিএইচডি করছি। সাধারণত, পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি শেষ করতে গড়ে প্রায় আট থেকে নয় বছর লাগে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে মাত্র ছয় বছরে পিএইচডি শেষ করতে পেরেছিলাম আমি। সে জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। এরপর আমার কাছে দুই ধরনের সুযোগ ছিল: আমি কারিগরি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিকে এগোতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে আজ আমার কাছে প্রচুর টাকা থাকত। অন্যদিকে একাডেমিক দিকে এলে আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হতো। তবে আমি লাইগো প্রজেক্ট নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা একদিন সফল হব। আর সেই সফলতা পদার্থবিজ্ঞানের অন্য সব সফল ঘটনাকে ছাপিয়ে যাবে। প্রথম যেদিন আমাদের যন্ত্রে তরঙ্গটি ধরা পড়ে, হিসাব-নিকাশ শেষ না হলেও আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে এত দিন আসলে এটির সন্ধানেই ছিলাম সবাই। সেই সময়ের উচ্ছ্বাস ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের প্রায়ই বলা হতো যে এই তরঙ্গ খুঁজে পেতে হয়তো ১০০ বছরও লাগতে পারে। সেখানে এত কম সময়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি, ভাবলেই শরীরে শিহরণ জাগে। সেই সময়ে আমার মা মারা যাওয়ার খবর এলেও সেটি আমার মস্তিষ্কে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি।
প্রশ্ন: আপনার এই বিরাট সফলতার সঙ্গে আপনি বাংলাদেশকে কীভাবে সম্পৃক্ত করবেন?
দীপঙ্কর তালুকদার: বিশ্বের প্রত্যেক বাঙালির সফলতার পেছনে এ দেশের মানুষের গল্প রয়েছে। আমি প্রথম দিকে সেভাবে না ভাবলেও পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছি, আমার দেশের সব মানুষের ভালোবাসা এবং তাদের সম্মিলিত অনুপ্রেরণাই আজ আমাকে এই সফলতা এনে দিয়েছে।
প্রশ্ন: সাধারণ পেশার বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের যে তরুণেরা বিজ্ঞানী হতে চায়, তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?
দীপঙ্কর তালুকদার: বিজ্ঞান আসলে সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে রয়েছে। আজকে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কেউ ডাক্তার হতে চায় কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। সেগুলোও কিন্তু বিজ্ঞানের এক-একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, তারা যেন বিজ্ঞানকে ভালোবেসে এসব পেশায় আসে। শুধু অর্থ উপার্জন তাদের লক্ষ্য হলে কিন্তু প্রকৃত বিজ্ঞান তাদের অগোচরে থেকে যাবে। পৃথিবীতে এখনো অনেক রোগের চিকিত্সা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। ডাক্তার হলে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার হলে নতুন করে কোনো সম্ভাবনাময় আবিষ্কার করতে হবে। বিজ্ঞানের যে শাখাতেই কাজ করুক না কেন, সেখানে পরিবর্তন আনতে পারাটাই বিজ্ঞানের আসল সফলতা।
প্রশ্ন: আমাদের দেশের বিজ্ঞানী কিংবা শিক্ষার্থীদের লাইগো প্রজেক্টে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ আছে কি?
দীপঙ্কর তালুকদার: সে ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের লাইগো প্রজেক্টের প্রাথমিক সফলতার পরই ভারত সরকার তাদের নিজস্ব অর্থায়নে লাইগোর মতো আরেকটি ডিটেক্টর স্থাপন করতে চেয়েছে। যেটি আমাদের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা পরিচালনা করবেন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আসলে সরকারিভাবে বিজ্ঞান গবেষণায় বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। এখনো আমাদের দেশের যেকোনো অবকাঠামোগত কাজে আমরা বিদেশি প্রকৌশলীদের ওপর নির্ভরশীল। কেননা আমাদের দেশের প্রকৌশলী বা বিজ্ঞানীরা গবেষণামূলক কাজে তেমন অভিজ্ঞ নয়। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা খাতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই বাংলাদেশকে বিশ্ব বিজ্ঞানের মঞ্চে তুলে ধরা সম্ভব।
প্রশ্ন: নতুন ম্যাগাজিন হিসেবে বিজ্ঞানচিন্তার জন্য কিছু বলবেন?
দীপঙ্কর তালুকদার: বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক, লেখক এবং এই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তিকে জানাই আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। আর পাঠকদের উদ্দেশে আমি বলব, বিজ্ঞানকে জানতে হলে প্রশ্ন করতে হবে। বিজ্ঞানের কোনো বিষয় জানার পরই সেটি কেন হলো, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। একমাত্র প্রশ্ন করার মাধ্যমেই বিজ্ঞানের মৌলিক জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। অন্যদিকে লেখক ও প্রকাশকদের জন্য বলব, বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে বেশি রঞ্জিত করবেন না। সব সময় সঠিক ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞান তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করবেন। পশ্চিমা দেশগুলোর ছোটদের বিজ্ঞান সাময়িকীগুলো কাগজের পাশাপাশি তাদের অনলাইন ভার্সন চালু রাখে। ফলে বাচ্চারা বিজ্ঞানের কোনো নতুন বিষয় সম্পর্কে জানলে তারা সঙ্গে সঙ্গে সেটার ব্যাপারে আরও বিস্তারিতভাবে ইন্টারনেট থেকে জানতে পারে। আশা করি, ভবিষ্যতে আপনারাও আমাদের দেশের শিশুদের জন্য এ রকম সুযোগ সৃষ্টি করবেন। বর্তমান প্রজন্মকে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও দক্ষ করে তুলতে এই ম্যাগাজিনের মতো মহৎ উদ্যোগকে আমার এবং লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের পক্ষ থেকে অসংখ্য অভিনন্দন।
দীপঙ্কর তালুকদার, পদার্থবিজ্ঞানী ও গবেষক
সৌজন্যে: বিজ্ঞানচিন্তা