রাশেদা রওনক খান: প্রথম হোঁচট খেয়েছিলাম তার একটি রিপোর্ট পড়ে, সম্ভবত পুরো জাতি হোঁচট খেয়েছিল সেদিন আমার মতো করেই, সেটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পদকের সোনায় কি পরিমাণ ফাঁকি দেয়া হয়েছিলো তা আমাদের জানিয়ে দেয়ার মতো সাহসী রিপোর্ট তিনি করেছিলেন| মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেয়া ক্রেস্টে এক ভরি সোনার বদলে সোনা আছে ৪ আনা আর ১২ আনাই ফাঁকি, মনে আছে নিশ্চয়ই সবার! আমার ধারণা এই রাষ্ট্র কেবল নয়, একজন সাধারণ নাগরিকও সেদিন লজ্জায় মাথা নত করেছিল।
পুরো জাতিকে বিদেশিদের কাছে লজ্জিত করতে যাদের হাত পা কাঁপেনি, তারা সব জায়গাতেই আছে, কিন্তু তারাই সব নয়, গুটি কয়েক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তো এই ক্ষেত্রে লিজেন্ড হবার পথে তাতো আমরা সবাই কম বেশী জানি|ব্যক্তি রোজিনা ইসলামকে আমি চিনি না, কিছু কিছু মানুষ তার কাজ দ্বারাই পরিচিত হয়ে উঠেন, চেহারায় নয়| সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সেইরকমই একজন! কোভিড কালীন এই দুঃসময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ দুর্নীতি ফাঁস করেছিলেন প্রথম এই রোজিনা ইসলামই! আরও অনেককিছুই ফাঁস হতে যাচ্ছিলো হয়তো তার হাত ধরে, তাই তার হাতটি মচকে দেয়া জরুরী মনে হয়েছিলো সেইসব দুর্নীতিবাজদের| স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ গিলে খাচ্ছে, তা অনুসন্ধান করতে গেলে এই ধরণের নিপীড়ণের শিকার কেন হতে হবে, তা অনুধাবনের জন্য রকেট সায়েন্স বুঝার প্রয়োজন হয়না।
রোজিনা ইসলামদের মতো প্রতিভাবান সাংবাদিকদের না রাষ্ট্র, না যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেন সেইসব প্রতিষ্ঠান, না আমরা- কেউই তাদের প্রতিভা, নিষ্ঠা আর সততাকে মূল্য দিতে শিখেছি! তো সেখানে চোর- দুর্নীতিবাজরা মূল্য দেবে তা ভাবি কি করে?তবুও মনে প্রশ্ন জাগে, এই দেশে চোর-বাটপার-দুর্নীতিবাজরা এই ধরণের সাহসী সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে, হামলা করে সত্য উচ্চারণ এর টুঁটি চেপে ধরবে, সেটাই কি এখনকার বাস্তবতা? আর এই বাস্তবতা আমরা মেনেও নিচ্ছি অবলীলায়?আরো কিছু প্রশ্ন- এই পরিস্থিতি কি আজ একদিনে তৈরী হয়েছে? কেন তৈরী হলো? কিভাবে দিনের পর দিন গণমাধ্যম এতটা দুর্বল অবস্থানে চলে গেলো? কারা এর জন্য দায়ী? নিজেদের দিকে কি এখন তাকানোর সময় এসেছে? একজন সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী জায়গা হতে শারীরিকভাবে নিপীড়িত হবেন, এই কোন বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি?
আচ্ছা, এই আক্রমণটা কি ব্যক্তি রোজিনা ইসলামের উপর আক্রমণ? বা একান্তই প্রথম আলোর উপর? নাকি মুক্ত চিন্তা চেতনার উপর আক্রমণ? ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনের উপর আক্রমণকে সহজ করে দেখার কি কোন উপায় আছে? গণমাধ্যমের হর্তাকর্তা যারা, তারা কি এক হয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে নিজেদের এই শোচনীয় অবস্থান নিয়ে দেনদরবার করবেন? এবার বোধহয় কেবল সাংবাদিক সম্মেলনে নয়, দেন-দরবারের টেবিলে গিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পালা…. বিষয়টা কিন্তু আত্মমর্যাদার!এতোটা দুঃসাহস এই ধরণের সৎ সাংবাদিকদের উপর দেখানো যায়, তা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে.. এই দুঃসাহস ও সুযোগ তৈরির পেছনে কি গণমাধ্যমের হর্তাকর্তাদের কোনো দায় নেই? নাকি ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রোল’ এখনও এই নব্য উপনিবেশবাদপুষ্ট কর্পোরেট গণমাধ্যমেও জারি রয়েছে এবং থাকবে অন্তকাল ধরে? রোজিনা ইসলামের মতো একজন পরীক্ষিত গণমাধ্যমকর্মীর মুক্তির ব্যাপারে, দেন-দরবার করার ক্ষেত্রে উনাদের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করতে যে নৈতিক ভিত্তি থাকা প্রয়োজন, সেটাও কি হারিয়ে ফেলেছেন কিনা, ভেবে দেখা দরকার!
শেষ প্রশ্ন, একজন সাংবাদিককে যারা টুঁটি চেপে ধরতে পারে, তারা রাষ্ট্র এর দেয়া কোভিড ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কি করে সঠিকভাবে পালন করবে? যে বা যারা নিজেদের পেশাদারিত্বের জায়গা কিংবা সীমা কতটুক তা বুঝেনা, এরা কি দায়িত্ব পালন করবে রাষ্ট্রের? প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক কোন ক্ষমতাবলে একজন সাংবাদিক তো দূরের কথা, প্রজাতন্ত্রের কোন এক নগণ্য নাগরিকের টুঁটি চেপে ধরতে পারে? কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা, ভয় কিংবা আক্রোশের জায়গা হতে একজন সাংবাদিকের টুঁটি চেপে ধরে আমলাতন্ত্রকে কলুষিত করার অধিকারইবা তাকে/তাদের কে দিয়েছে? একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিককে এভাবে নিপীড়ন করার সাহস কোথা থেকে উৎপাদন হলো, কিভাবে হলো? কারা এর জন্য দায়ী? যদি তিনি স্পর্শকাতর তথ্য নিয়েও থাকেন, সেই জন্য তৎক্ষণাৎ পুলিশ না ডেকে ছয় ঘন্টা আটকে রেখে হেনস্থা করা হল কেন? এই পাঁচ/ছয় ঘন্টা কি করা হয়েছিল তার সাথে?
লেখক:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
(সাইবারবার্তা.কম/আইআই/১৮ মে ২০২১)